করোনাভাইরাস রুখতে ভিড় এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবুও চায়ের দোকানে জটলা। রবিবার সিউড়িতে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
সত্তরের দশক। চারধার শুনশান। নীরবতা ভেঙে বুটের সশব্দ রুট মার্চ। স্বপ্ন দেখা কিশোর থেকে তরতাজা যুবক বাড়িছাড়া, পাড়াছাড়া। বেঁচে থাকার লড়াই শুধু। যেনতেন প্রকারে বেঁচে থাকা। রুটিরুজির টানে রাস্তাঘাটে বেরোতে বাধ্য হওয়া পথচারী, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া মানুষটির বারবার দেহতল্লাশি, জেরায় জেরায় জেরবার। সমগ্র ছাত্র সমাজ দিশাহীন। তবু একটাই কথা যেন অবচেতনে কাজ করত, ‘আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি।’
এরিয়া ডমিনেশন, বম্বিং কখন যেন হয়ে উঠেছিল আদ্যোপান্ত বাংলা শব্দ, ঢুকে পড়েছিল নিরক্ষর বাঙালির মনেও। আর নিরক্ষর তখনও সাক্ষরের চেয়ে অনেক বেশি। তখনও শুরুই হয়নি নিরক্ষরতা দূরীকরণের মহাযজ্ঞ। তখনও বইয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল তীব্র। লেখাপড়া জানা মানুষের প্রতি সম্মান ছিল, সমীহ ছিল। বই পড়া মানুষগুলির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত অনেক জোড়া চোখ। তাকিয়ে থাকত হাতের কাছে পাওয়া দেবদূতসম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রুক্ষসূক্ষ উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে। সে ছিল আমার জীবনে দেখা প্রথম কার্ফু, এক অঘোষিত কার্ফু। দিনে দুপুরেও। অথচ কেন যে তাকে ‘সান্ধ্য আইন’ বলা হত কে জানে। হয়তো সন্ধ্যা, রাত্রির অপরাধপ্রবন প্রহর থেকে নির্বিরোধী জনজীবনকে নিরাপত্তা দিতে। কিন্তু প্রত্যুষের ব্রাহ্ম মুহূর্ত থেকে দুপুর হয়ে প্রদোষ কালেও যখন তখন আরোপিত হয়েছে নিষেধ! হয়তো... হয়তো বা চারধারে নেমেছে তখন, ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার...’
সত্তরের দশকের এ এক আটপৌরে চিত্র। মূলত শহরকেন্দ্রিক, নগরকেন্দ্রিক চালচিত্র। দু’টো ভারত না হোক দু’টো বাংলা যে বিরাজ করছিল সেই উত্তাল দশকে একথা বলাই যায়। মানুষ দেখেছে দাপাদাপি, হানাহানির পরেই রাষ্ট্রের সশব্দ পদচারনা। তবে সেই সময়েও গ্রাম বাংলা সেভাবে সুনসান থাকেনি, যেভাবে ছিল শহর, নগর, মফঃস্বল।
ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি বাংলায় নীরবতার ভয়ানক উপস্থিতিকে চিনেছি দামাল সময়ের অভিজ্ঞতার নিরিখে। সেই নৈঃশব্দ কেড়ে নিয়েছে তরতাজা অসংখ্য তরুণের স্বপ্নকে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ঠিকানা হয়েছে লাশ কাটা ঘরে, মর্গের গুমোটে, ... মৃতদেহ শনাক্ত করতে ভয় পেয়েছে মা, বাবা, প্রিয়জন – হাজার চুরাশির মা আড়ালে চোখ মুছেছে। তবু ছিল সকলের বেঁধে বেঁধে থাকা। ১৯৭৭সালে থমকে থাকা ভয়, গুমরে থাকা রাগ, ঘর বন্দি সময়ের মাঝে কখন যেন তীব্র জলপ্রপাত। মানুষের ঢল রাস্তায়। সুনসান ভয় উধাও, ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল...’
১৯৮৪র অক্টোবরের শেষ। দ্বিতীয় কারফিউ দেখলাম। সমগ্র দেশ জানল নিজের নিরাপত্তারক্ষীর হাতে নিহত দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, জাতীয় নেতাও। অবাধে চলল ধ্বংস লীলা। দিল্লি সহ বিভিন্ন প্রান্তে। ব্যতিক্রম বাংলা। শাসক নিজেই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ডেকে দিল বনধ্। প্রশাসন সচল বাকি সব নিথর। দু’দিন বনধ্ শেষে জনজীবন স্বাভাবিক। অন্ধকারের কীটদের অভিসন্ধি মাঠে মারা গেল। সেদিন নারকীয় হত্যার বিরুদ্ধে বনধ্ ডেকে প্রতিবাদের আড়ালে ছিল প্রতিশোধের নাম নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টাকে রুখে দেওয়া। শুধু সচেতনতা দিয়ে তা হয়নি, প্রশাসন বনধ-এর দু’দিন কাউকে রাস্তায় নামতেই দেয়নি। বনধের আড়ালে কার্ফু। নিন্দুকে বলল, “সরকার বনধ ডাকছে! নৈরাজ্য, চরম নৈরাজ্য”। মানুষ দেখল কিভাবে সুকৌশলে নৈরাজ্য নস্যাৎ করা হল।
কয়েক দশক পেরিয়ে ২২ মার্চ, ২০২০। প্রত্যক্ষ করলাম জীবনের তৃতীয় কার্ফু। তবে, এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। আগে বনধ্ হয়েছে, হরতাল হয়েছে, সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে – দুপক্ষের তীব্র বাদানুবাদ সত্ত্বেও প্রশাসনের উপস্থিতি রাস্তাঘাট, হাটবাজার, অফিস আদালতকে একেবারে সুনসান হতে দেয়নি। আজ বনধ নয়, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কার্ফুও নয়। অথচ সব স্তব্ধ, সুনসান। সারা দেশ ঘরবন্দি, স্বেচ্ছায়। স্ব-আরোপিত সান্ধ্য আইন। সকাল থেকে রাত্রি। অব্যক্ত শ্লোগান, ‘ব্রেক দ্য চেইন, ব্রেক দ্য চেইন।’ তবে এর চরিত্র বেশ খানিকটা আলাদা। রাজনৈতিক কার্ফু স্থান দেখে, জাত দেখে, ধর্ম দেখে, রং দেখে- ভাইরাস এর একটাও দেখে না। তাই শুধু শহর নয়, প্রত্যেক গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে মানুষই জারি করে নিয়েছে কার্ফু। কোনও চাপা অসন্তোষ নেই, কোনও ছাইচাপা আগুনের ফুলকি নেই, কেউ কাউকে ভয় করছে না, ভয় দেখাচ্ছে না, দোকান খুললে ভাঙচুরের ভয় নেই, বাড়ি থেকে বের হলে গুলি বা নিদেনপক্ষে লাঠি খাওয়ারও ভয় নেই, তাও ঘরে নিজেকে বন্দি রেখে মানুষই প্রমাণ করল, ‘কখনও কখনও একা হতে হয় সমগ্রের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে’। এই একাকীত্ব কোনও চাপিয়ে দেওয়া আদেশ পালন নয়। সচেতনতা ও স্ব-চেতনা। কোভিড ১৯ শেখালো প্রাচীন হাতকে কপালে উঠতে দেখলেই কপাল থেকে নামিয়ে কলতলায় নিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মূর্তি, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা নয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্র অনেক বেশি জরুরি। মক্কা, মদিনা, ভ্যাটিকান, মঠ নয় চিকিৎসাই শেষ কথা। সচেতনতাই প্রতিরোধের উপায়। তালি বাজিয়ে, থালি বাজিয়ে বা শাঁখ বাজিয়ে জীবানুনাশ হয় না।
আজও অবচেতনে একটাই কথা কানে আসছে। একই সুরে, শুধু বদলে গিয়েছে শব্দগুলো। আয় সবে ছেড়ে ছেড়ে থাকি।
লেখক সংস্কৃতি কর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy