Advertisement
১১ মে ২০২৪
Coronavirus

সেবার প্রদীপটি তাঁরা জ্বালিয়ে রেখেছেন

আদি যুগ থেকে সেবিকারা মানবজাতির সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। আজ যখন কোভিড-১৯ বিনষ্ট করে দিতে চাইছে মানুষের স্বাস্থ্যের সংসার, তখনও চিকিৎসক-সহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সেবিকারা জারি রেখেছেন সংগ্রাম। তাঁদের প্রাপ্য সুরক্ষা ও সম্মান থেকে তাঁরা যেন বঞ্চিত না হন। গত দু’বছর বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবসের বিষয় বা ‘থিম’ ছিল, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য: সবার জন্য, সর্বত্র’।

শপথ নেওয়ার সময়ে। ফাইল ছবি

শপথ নেওয়ার সময়ে। ফাইল ছবি

অরুণাভ সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২০ ০১:৫৩
Share: Save:

নার্স তথা সেবক স্বাস্থ্য পরিষেবার বৃহত্তম এবং এক অপরিহার্য অঙ্গ। অনুচ্চারিত ও পরিপাটি সেবার মাধুর্যে তাঁরা অসুস্থ ও অক্ষমের রুক্ষ পৃথিবীকে করে তোলেন কোমল ও লাবণ্যময়। নার্সেরা শুধু অসুস্থ, আহত, অক্ষম এবং মুমূর্ষু মানুষের সেবাই করেন না, সামাজিক প্রেক্ষিতে মানুষকে, তাঁর পরিবারকে এবং সমাজকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা, অসুস্থতাকে নিবারণ করাটাও এই পেশাটির কাজ। বর্তমানে স্বাস্থ্য পরিষেবার গবেষণা, পেশাদারি পরিচালনা (ম্যানেজমেন্ট), নীতি নির্ধারণে সহায়তাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন এই পেশার মানুষেরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) স্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল। প্রথম অধিবেশনেই স্থির হয় যে, ১৯৫০ সাল থেকেই ৭এপ্রিল দিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার উদ্যোগে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। এটি পালন করা হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্যের কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে, সেটির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। গত দু’বছর বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবসের বিষয় বা ‘থিম’ ছিল, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য: সবার জন্য, সর্বত্র’। ক’দিন আগেই চলে গেল দিনটি।

এ বছর ২০২০ সাল ‘আন্তর্জাতিক নার্স এবং ধাত্রী বর্ষ’। তাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এ বছরের বিষয় বা থিম ছিল, ‘সাপোর্ট নার্সেস অ্যান্ড মিড ওয়াইভস’। এই পেশাটি মূলত নারীদেরই। যদিও এখন অনেক পুরুষও এই পেশায় যুক্ত। ইতিহাস বলছে, এই পেশা নারীকে লিঙ্গবৈষম্যের থেকে বৃত্তি বা কাজের জগতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জগতে উত্তরণ ঘটিয়েছে।

‘নার্স’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Nutrire’ থেকে, যার অর্থ ‘স্তন্যপান করানো’। ‘স্তন্যদায়িনী মা’ বা ‘দুধ-মা’-এর কথা আমরা জানি। গর্ভধারিণী মা কোনও কারণে (শারীরিক অক্ষমতার জন্যই হোক বা স্তন্যপান করানো ‘কেতাদুরস্ত বা ফ্যাশনেবল’ নয় মনে হওয়ার জন্যই হোক) স্তন্যদান করাতে অক্ষম হলে, সেখানে তাঁদের ভূমিকা ছিল। এখান থেকেই ‘নার্স’ কথাটির উদ্ভব হয় তাঁদের জন্য, যাঁরা অক্ষম ও রোগীদের সেবা করতেন।

ইতিহাস দেখায়, ‘নার্স’ পেশা শুরু হয় সেবামূলক কাজের সূত্রে। আর তা হয় খ্রিস্টান এবং ইসলামিক ধর্মীয় সেবা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। তার জন্যই হয়তো তাঁরা পেয়েছেন ‘সিস্টার’ নামটি। ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এর ষষ্ঠ গ্রন্থ-এ উল্লেখ আছে, খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতাব্দীতে জিশুর শিষ্য সেন্ট পল, ফেবি নামের এক মহিলাকে অসুস্থদের সেবার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। ঐতিহাসিক জিওফ্রে ব্লেনি-র মতে খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গুটি বসন্তের এবং দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি হামের মহামারির সময়ে আদি খ্রিস্টানদের উদ্যোগে ধর্ম নির্বিশেষে সেবামূলক নার্সিং-এর কাজ শুরু হয়।

মধ্যযুগে এবং তার পরে ক্যাথলিক মহিলারা স্বাস্থ্য ও সেবাগত ব্যাপারে নার্স হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। সে সময় ‘নান’-এর জীবন বেছে নেওয়া ছিল সম্মানজনক। তাঁরা দুঃস্থদের দিতেন নার্সের সেবা।

খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় শতকের শেষ দিকে সেন্ট বেসিল প্রমুখ যাজকদের উদ্যোগে (তাঁদের কেউ কেউ আবার চিকিৎসকও ছিলেন) কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) প্রভৃতি স্থানে রোগীর থাকা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বলাই বাহুল্য, এটিই আজকের হাসপাতালের আদিরূপ যার সূত্রপাত ওই বাইজান্টাইন সভ্যতাতেই। ইসলামেও সেবার ভূমিকাটি ছিল উজ্জ্বল। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নার্সের নাম রুফাইদা বিন সাদ। তিনি ছিলেন হজরত মহম্মদের সমসাময়িক। তিনি মহম্মদের অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে এবং যুদ্ধের পরে মদিনায় রোগীদের সেবা করেছেন। মেয়েদের নার্সিং-এর প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। মধ্যযুগে মুসলিম সমাজে হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল। তাতে পুরুষদের জন্য পুরুষ নার্স এবং মহিলাদের জন্য মহিলা নার্স নিয়োজিত হত। ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি দিমনার আল-দিমনা হাসপাতালে সুদান থেকে পেশাদার নার্স আনা হত।

আধুনিক নার্সিং পদ্ধতির অগ্রদূত হিসেবে যাঁর নাম আসে, তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সে-র এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম তাঁর। সে সময় জীবিকা হিসেবে নার্সিং মোটেও সম্মানজনক ছিল না। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন সেবিকার জীবন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সেবিকা হিসেবে কনস্টান্টিনোপল হাসপাতালে যোগদান করেন। অক্লান্ত সেবায় উন্নত ও উজ্জীবিত করে দেন হাসপাতালের পরিস্থিতিকে। মৃত্যুহার কমে যায় দুই-তৃতীয়াংশ। মধ্যরাতে হাতে বাতি নিয়ে বেরোতেন রোগী পরিচর্যায়। শ্রদ্ধায় উপহার পেলেন নাম, ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। পরে স্থাপন করেন নার্সিং স্কুল। তিনি শুধু আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থার সূচনাই করেন না, ছিলেন এক জন মেধাবী পরিসংখ্যানবিদ, এক জন সার্থকনামা লেখক। রোগীসংক্রান্ত পরিসংখ্যানে প্রথম সফল ভাবে ব্যবহার করেন ‘পাই চার্ট’। তাঁর স্মরণে নার্সিং পরিষেবার জন্য দেওয়া হয়, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল মেডেল’-এর মতো আন্তর্জাতিক সম্মান।

বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে লেখকদের কলমে উঠে এসেছে নার্সদের ভূমিকার কথা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-র ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’-এ আছে নার্সের ভূমিকায় ক্যাথরিন বার্কলে নামে এক উজ্জ্বল চরিত্র। তাঁর ‘দ্য স্নো অফ কিলিমাঞ্জারো’-এর মতো ছোটগল্পে উজ্জ্বল হয়ে থেকেছে সেবিকার চরিত্র। এই চরিত্রগুলির প্রেরণা আগনেস ভন কুরোস্কি নামের এক মার্কিন নার্স। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিলানের রেড ক্রস হাসপাতালে ভর্তি ১৯ বছরের হেমিংওয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। প্রেমটি পূর্ণতা পায়নি ঠিকই, কিন্তু তা প্রেরণা হিসেবে উস্কে দিয়েছে তাঁর সৃষ্টিকে।

জামাইকা-জাত মেরি সিয়াকোল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নার্স হিসেবে নাইটিংগেলের মতোই পরিষেবা দিয়েছিলেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হিসেবে লিখেছেন আত্মজীবনীমূলক বই, ‘ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার্স অব মিসেস সিয়াকোল ইন মেরিল্যান্ডস’। কিন্তু মৃত্যুর ১০০ বছর পরে পর্যন্ত ছিলেন অনালোচিত। সলমন রুশদি তাঁর ‘স্যাটিনক ভার্সেস’-এ আক্ষেপ করেছেন, হয়তো কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার জন্যই তিনি পাননি প্রচারের আলো।

সেই আদি যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সেবিকারা মানবজাতির সেবায় আছেন নিবেদিতপ্রাণ। আজ যখন কোভিড-১৯ বিনষ্ট করে দিতে চাইছে মানুষের স্বাস্থ্যের সংসার, তখন চিকিৎসক-সহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেবিকারা জারি রেখেছেন এই নতুন ব্যাধির বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম। তাঁদের প্রাপ্য সুরক্ষা ও সম্মান থেকে তাঁরা যেন বঞ্চিত না হন, এই আজ সময়ের দাবি।

আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE