Advertisement
১১ মে ২০২৪
Coronavirus

করোনা-মোকাবিলায় সামাজিক চিন্তনের পুনর্বিন্যাস

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তার সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকার ভিসা প্রদানের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ করেছে। রবিবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশে নামবে না আন্তর্জাতিক বিমান। কিন্তু, এমন পদক্ষেপ আগে নয় কেন? করোনাভাইরাস এবং রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আলোচনায় গৌরীশঙ্কর নাগ গত ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় আমরা যে যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম না— তা এখন বেশ মালুম হচ্ছে।

নয়াদিল্লিতে বিমান থেকে নামছেন যাত্রীরা। ফাইল চিত্র

নয়াদিল্লিতে বিমান থেকে নামছেন যাত্রীরা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ০৩:৫৫
Share: Save:

কেবল সর্দি, জ্বর বা ছোঁয়াচ থেকে সংক্রমণ। এমন আপাত নিরীহ একটা অসুখ তাবৎ বিশ্বের লক্ষাধিক মানুষ জীবনমৃত্যুর কারণ হয়ে গেল। বিগত দু’সপ্তাহে তার লেলিহান শিখায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল মৃত্যুর সংখ্যা।

গত ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় আমরা যে যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম না— তা এখন বেশ মালুম হচ্ছে। আবার ইতিহাস থেকেও আমরা শিক্ষা নিইনি। যদি নিতাম, তবে সাম্প্রতিক কালে সোয়াইন ফ্লু, নিপা বা ইবোলা আতঙ্কের কথা মাথায় রেখে এ বারে আমাদের গোড়া থেকে আরও অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। যেখানে এই ধরনের সুদূরপ্রসারী মহামারি প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও যে আঁটোসাঁটো সুরক্ষামূলক ঘেরাটোপ ও পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল, সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যর্থতা রীতিমতো বিস্ময়কর। দ্বিতীয়ত, আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে যে যখন এড্‌স-এর সংক্রমণ শুরু হল, তখন আমরা চটজলদি প্রতিষেধক জানতাম না। এখনও জানি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিন্তু আমরা মূহ্যমান হয়ে পড়িনি। করোনাভাইরাসের প্রকৃতি আলাদা হলেও এক্ষেত্রে তুলনা এই জন্য প্রয়োজনীয় কারণ, এড্‌স-এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গণ সচেতনার মাধ্যমে আমরা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলাম। কারণ, মহামারি বা অতিমারির মতো বিষয়ের সঙ্গে লড়াই করা সাধারণ অন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয় নয়। বরং, অনেকটা মেঘের আড়ালে থেকে মেঘনাদের যুদ্ধ চালানোর মতো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চা না করেও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সচেতন নাগরিক মাত্রেই জানেন আমেরিকার সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর নিয়ে, এমনকি, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কী ভাবে চিন, দক্ষিণ চিন সাগর থেকে শুরু করে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত তার দাপটকে প্রসারিত করে চলেছে। অথচ নিজেদের দেশে মূল জনস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে সে প্রথমে গোপনীয়তা ভ্রান্ত আশ্রয় ও পরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করেও একপ্রকার ব্যর্থ। এতে বিশ্বে চিনের মুখ পুড়বেই— তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা চিন-কে যেন এটা যথোচিত শিক্ষা দিয়ে জানিয়ে দিয়ে গেল যে, প্রকৃতিই প্রকৃত ‘সুপার পাওয়ার’। তার উপরে কেউ নয়। কোনও মানুষ নয়। কোনও রাষ্ট্র নয়।

তৃতীয়ত, ভাবতে অবাক লাগে, এমন অবস্থায় ‘কে মরে, আর কে হরি হরি বলে’! রাশিয়ার কাছে এটাই তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দখলের মোক্ষম সময়। তাই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার মুখে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতিকে গরম করতে ইতিমধ্যেই আসরে নেমে পড়েছেন পুতিন। পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি দখলে রাখতে তাই সংবিধান সংশোধনের পথে হাঁটতে চলেছে রাশিয়া। এক অর্থে ভারত, আমেরিকা ও রাশিয়ায় গণতন্ত্রের এহেন অধঃপতনের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সমাপতন লক্ষ্যণীয়।

চতুর্থত, ভারতেও করোনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রের পদক্ষেপ যদি খুঁটিয়ে দেখি, তাহলে আপাত ভাবে হয়ত আমরা আশ্বস্ত হলেও হতে পারি এইকথা ভেবে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তার সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকার ভিসা প্রদানের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ করেছে। বিমানবন্দরগুলিতে থার্মাল স্ক্রিনিং শুরু হয়েছে। যদিও ট্রাভেল অ্যাডভাইজারি থেকে আইপিএল বন্ধের সিদ্ধান্তে স্বস্তি এলেও বেশ একটা ঝলমলে ভাব দেখা গিয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধের সিদ্ধান্ত এত বিলম্বে নেওয়া হল কেন? বিমান ও রেল পরিবহণ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিল দিন দিন। সংক্রমণ ‘কমিউনিটি’তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও পদক্ষেপে দেরি। কিন্তু স্বস্তির বিষয়, দেরিতে হলেও বিমান-ট্রেন বাতিল এবং লকডাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। দুঃখের বিষয় এতদসত্ত্বেও মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের শেষে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি পৌঁছে গেল।

এ থেকে প্রশ্ন ওঠে, এতে বজ্র আঁটুনিতে ফস্কা গেঁরো হয়ে যাচ্ছে না তো? আসলে এই ধরনের অভূতপূর্ব ও অপ্রত্যাশিত এবং খানিকটা আকস্মিকও বটে— বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের অভিজ্ঞতা বলে আরও পূর্ব সতর্কতার প্রয়োজন ছিল। অথচ আমরা দেখলাম আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোর মধ্যেই বড়সড় ফাঁকফোকড়। জাতীয় ভাইরোলজি প্রতিষ্ঠানের এই জাতীয় টেস্টের জন্য ১৫টি পরীক্ষাগার রয়েছে মাত্র। প্রশ্ন হল ভারতের মতো জনবহুল বিশালায়তন দেশের জন্য তা কি যথেষ্ট ছিল? তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনিও আক্ষেপের সুরে জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক রোগ নির্ণয়কারী ‘কিট’ রাজ্যের কাছে পাঠানো হচ্ছে না। সেখানেও তো সমস্যা।

দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিতে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য জরুরি বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দেশ লাগোয়া মায়ানমার কি দোষ করল? তা ছাড়া, এই ধরনের সংক্রমণ রুখতে যে বিশেষ প্রশিক্ষণ, কোয়রান্টিন বিভাগ গড়ে তোলার কথা— দুঃখের বিষয় গ্রামাঞ্চলে তো দূর অস্ত, সব বড় শহরেও আদর্শ কোয়রান্টিন বিভাগ কি আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি? এই বিভাগে থাকার ‘ভয়ে’ই তো পালিয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন বিদেশ থেকে দেশে আসা একাধিক ভারতীয়।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত নতুন নাগরিকপঞ্জিকে রাজনীতির ‘মোহরা’ করে বিভিন্ন রাজ্যে যে বড় মাপের রাজনৈতিক সভাগুলি হয়েছে— তার কিছুমাত্র রসদ ও সদিচ্ছা যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির থাকত, তাহলে করোনার আটকাতে সাধারণ মানুষকে এতটা অসহয়তার মধ্যে, দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হত না। সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক জীবনমাত্রই ১০টা-৫টা জীবনসংগ্রাম। তাহলে এই বাড়তি দিশেহারা অবস্থা কেন? যে রাষ্ট্র নাগরিকদের আশ্বস্ত করে এই বলে যে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি থেকে নির্যাতিত হয়ে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নতুন করে নাগরিকত্বের অধিকার প্রদানের অর্থ সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ নয়, এখন জনস্বাস্থ্যের এই কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে সমান বলিষ্ঠতার সঙ্গে সে কেন পূর্ব পরিকল্পনা করতে পারে না?

তবে আমরা যেন ভুলে না যাই রাষ্ট্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা তার রয়েছে। তাই করোনার অভিঘাতে অর্থনৈতিক মন্দার মোকাবিলায় কিছুটা আর্থিক ত্রাণ দিয়ে পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। কিন্তু সমাজের পরিসর আরও অনেক বড়। সামাজিক চিন্তনের ক্ষেত্রটাও তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সে দিক থেকে দার্শনিক হব্‌স কল্পিত প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্দশা, আজকের একবিংশ শতকের আধুনিক সমাজেও আমাদের সমানে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই আধুনিকতার এত ধাপ পেরিয়েও ভাবতেই হয়, আমাদের বর্তমান ভোগবাদী জীবন কতটা টেকসই। নাকি আধুনিকতার ঘেরাটোপের মধ্যেও কোনও অসাবধানতা বা উদ্ভট পরীক্ষানিরীক্ষার সুড়ঙ্গপথে সঙ্কট দরজায় কড়া নাড়ে। মনে পড়ে যায়, ‘নিউটেস্টামেন্টে’-এর আরমাগেডনের কথা। এর দ্যোতনা হল, গ্লোবালাইজ়ড দুনিয়ায় চূড়ান্ত ভোগবাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের মাঝখানে দাঁড়িয়েও একটা আণুবীক্ষণিক ভাইরাস গোটা মানবসভ্যতার মেরুদণ্ড দিয়ে কেমন অনায়াসে একটা হিমশীতল স্রোতের প্রবাহ বইয়ে দিতে পারে। তাই মনে হয় মানুষের চূড়ান্ত সুরক্ষাকবচটা তাহলে কোথায়? রক্ষাকবচ রয়েছে সহজ সরল ‘কমিউনিটি লাইফ’এ। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ ও গাঁধীর ‘গ্রামস্বরাজের’ ধারণা ও দর্শনই হয়ত এই দমবন্ধকর পরিস্থতি থেকে আগামিদিনে আমাদের পরিত্রাণের পথ বাতলে দেবে। ততদিন আসুন আমরা সকলে একা একা থাকি। জুড়ে জুড়ে থাকি।

লেখক বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE