ভারতে লকডাউন যথাযথ ভাবে মানা হইতেছে না। শুধু ক্ষুধার জ্বালায় নহে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের তাগিদেও নহে। সমাজমাধ্যমে রঙ্গ চলিতেছে, ইহার মূল কারণ, বাড়িতে থাকিলেই পুরুষকে নানাবিধ গৃহকর্ম সারিতে হইতেছে। ফলে, সাংসারিক কর্মকাণ্ডে অনভ্যস্ত পুরুষরা রাস্তাকেই নিরাপদ মনে করিতেছেন। পঞ্জাবের উদাহরণটি মোক্ষম। সেখানে অনেক পুরুষই নাকি একটানা ঘরে বসিয়া হাঁপাইয়া উঠিতেছেন। তাই তাঁহারা মাঝেমধ্যেই রাস্তায় নামিতেছেন দেশের পরিস্থিতি বুঝিতে। এই বহির্মুখী পুরুষদের ঘরে আটকাইয়া রাখিতে যে পরামর্শ পঞ্জাব পুলিশ দিয়াছে, তাহা আশ্চর্যজনক ভাবে বহুলচর্চিত রঙ্গগুলির মতোই— গৃহকর্মে পুরুষদের ব্যস্ত রাখা। তাহাতে গৃহিণীর পরিশ্রম কমিবে, দেশও বাঁচিবে।
ভারতীয় পুরুষরা জন্মাবধি শুনিয়া আসিতেছেন, তাঁহাদের জন্মই হইয়াছে বাহিরের কাজ করিবার জন্য। তিনি রোজগার করিবেন, সুতরাং বাহিরের জগৎ তাঁহার। আর বাড়ির মহিলারা সামলাইবেন অন্দরমহলটি। তিনি রান্না করিবেন, সন্তান পালন করিবেন, এবং পুরুষকে সন্তুষ্ট রাখিবেন, যাহাতে সংসারের চাকাটি মসৃণ ভাবে ঘুরিতে পারে। এই স্বাভাবিক নিয়মে ছেদ পড়িলে বিপদ বইকি। যে পুরুষ সকালে স্ত্রীর হাতের রান্না খাইয়া, পরিপাটি গুছাইয়া রাখা টিফিনবাক্সটি লইয়া অফিসের পথে রওয়ানা হইতে এবং দিনান্তে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাড়ার আড্ডায় বক্তৃতা-অন্তে বাড়ি ফিরিয়া চায়ের দাবি জানাইতে অভ্যস্ত, তিনি এই উলটপুরাণে হাঁপাইয়া উঠিবেন অবশ্যই। সুতরাং, আমোদপ্রিয় সমাজমাধ্যমে ঘুরিতেছে বিপন্ন পুরুষের নানাবিধ চিত্র। কোথাও দোর্দণ্ডপ্রতাপ গৃহিণীর তিরস্কারে থরহরিকম্প হইতেছেন স্বামী, কোথাও করোনাভাইরাসের ত্রাসে গৃহবন্দি স্বামীর সঙ্গে অযথা কোন্দল না করিবার উপদেশ বর্ষিত হইতেছে মহিলাদের প্রতি।
পুরুষের বিপন্নতার এই আপাতসরল চিত্রগুলির মধ্যে এক ভয়ঙ্কর লিঙ্গবৈষম্য বিদ্যমান। ইহার মধ্যে এক দিকে যাবতীয় সাংসারিক অশান্তির দায় মহিলাদের স্কন্ধে অর্পণ করা হইল, অন্য দিকে, সাংসারিক সমস্যা হইতে নিজেকে বাঁচাইয়া পুরুষের শুধুমাত্র বহির্জগৎ লইয়া ব্যস্ত থাকিবার প্রবণতাটিকেও বৈধতা দেওয়া হইল। মর্মান্তিক। বস্তুত এই চিত্রটির জন্য মহিলারাও দায়ী। ভারতীয় মা এখনও পুত্রদের গৃহকর্মনিপুণ করিয়া গড়িয়া তুলিতে চাহেন না। কারণ, তাহা পুরুষোচিত কাজ নহে। পুরুষ ঘর মুছিবে, বাসন মাজিবে কেন? নারী উদয়াস্ত পরিশ্রম করিবেন, যথাসময়ে খাইবার সময়টুকুও পাইবেন না, অসুস্থতা লইয়াও রান্নাঘরে ঢুকিবেন, অথচ স্বামী-ছেলেকে সংসারের দায়িত্ব ভাগ করিয়া দিবেন না। তর্ক উঠিতে পারে, অবস্থা পূর্ববৎ নাই। এই যুগের পুরুষরাও গৃহকর্মে সমান তালে মহিলাদের সাহায্য করেন। কথাটি ঠিক, কিন্তু তাহা আংশিক সত্য। যথাযথ হিসাব করিলে দেখা যাইবে, পাল্লা মেয়েদের দিকেই ঝুঁকিয়া। চাকুরিরতা মেয়েকেও বাড়ি ফিরিয়া চা বানাইতে হয়, সন্তানের পাঠে সাহায্য করিতে হয়। কারণ, তাঁহার ক্ষেত্রে ইহা কার্য নহে, অবশ্যকর্তব্য। সংক্রমণের ভয়ে বহির্জগৎ রুদ্ধ হইতে পারে, পুরুষের রোজনামচায় বদল আসিতে পারে, কিন্তু মেয়েদের কর্তব্যে পরিবর্তন আসে না। রঙ্গ করিবার পূর্বে এই বিষয়টি মনে রাখিলে ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy