Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সিপিএম বরাবরই ঝোপ বুঝে জোট বাঁধে

কংগ্রেসে অরুচি নেই? এমনকী মুকুল রায়ও চলতে পারে? সে আর নতুন কী হল? অভিজ্ঞতাই বলে দেয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) যখন যে ঘাটে সুবিধে তখন সে ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।কংগ্রেসে অরুচি নেই? এমনকী মুকুল রায়ও চলতে পারে? সে আর নতুন কী হল? অভিজ্ঞতাই বলে দেয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) যখন যে ঘাটে সুবিধে তখন সে ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।

সহযাত্রী। দমদম বিমানবন্দরে ইন্দিরা গাঁধী ও জ্যোতি বসু। জুলাই, ১৯৬৯

সহযাত্রী। দমদম বিমানবন্দরে ইন্দিরা গাঁধী ও জ্যোতি বসু। জুলাই, ১৯৬৯

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র নেতা গৌতম দেব বলেছেন, রাজনীতিতে (অর্থাৎ ভোটের রাজনীতিতে) কেউ অস্পৃশ্য নয়, এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁদের কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধবার ইচ্ছার। এমনকী এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে তৃণমূলের অধুনা নিষ্প্রভ সাংসদ মুকুল রায়ের সঙ্গেও বার্তা-বিনিয়মে তাঁদের কোনওই অস্বস্তি নেই। এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিপুল হইচই পড়ে গিয়েছে: এ নাকি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সীতারাম ইয়েচুরি উদ্ভাবিত রাস্তা!

ঘটনা হল, সিপিএমের জন্মলগ্ন, অর্থাৎ ১৯৬৪ থেকে কোনও দিনই এই লালপার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের মুখ-দেখাদেখি না থাকার সম্পর্ক ছিল না। ক্যাডাররা লড়ে মরেছেন, কিন্তু নেতায় নেতায় কোলাকুলিতে বাধেনি। বস্তুত, ফাঁকতালে ক্ষমতায় আসতে সিপিএম বিভিন্ন সময়ে বহু বিচিত্র দলের সঙ্গে আঁতাঁত করেছে। মার্ক্সবাদ বাধা হয়নি।

১৯৬৪’র পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচি অনুযায়ী সিপিএম নেতৃত্ব ঘোষণা করেন, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে তাঁরা প্রথমে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে ভারতের মাটি থেকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি, ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করবেন, তার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাঁদের লক্ষ্য। এই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্লোগানকে যাতে কেন্দ্রীয় সরকার ভুল না বোঝে, এ জন্য লালপার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া দেখা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দের সঙ্গে। তিনি লিখছেন, ‘(১৯৬৪ সালের) ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নন্দের সঙ্গে আমি যখন দেখা করলাম... তাঁকে বললাম, আপনাদের পুলিশ রিপোর্টকে বিশ্বাস করবেন না। আপনাদের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করুন। আমরা কোনও ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবছি না। আমরা আইনি পার্টি, প্রকাশ্যে কাজ পরিচালনা করি। যত দিন আমাদের এই সব গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, তত দিন আমরা শিশু নই যে সেগুলি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তথাকথিত আত্মগোপনের পথ বেছে নেব।’ এবং, ‘তেলঙ্গানা ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে আমরা আত্মগোপন করার জন্য প্রস্তুতি হচ্ছি, এই অপবাদ আমি আবার স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছি। যদি আত্মগোপনের কথা চিন্তা করতাম, তা হলে আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে নিপীড়ন না চালানোর জন্য আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন্দ ও আমাদের প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে নিজেদের জন্য ওকালতি করতাম না।’ অর্থাৎ, নতুন পার্টির বিরুদ্ধে কেন্দ্র যেন দমনমূলক ব্যবস্থা না নেয়, তার জন্যই এ আবেদন, এই ব্যাখ্যা। যাঁরা নাকি বিপ্লব করে পুঁজির বিলোপ করবেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবেন, তাঁরা জন্মলগ্নেই ‘পুঁজির প্রতিনিধি’ কংগ্রেসের সহযোগিতা চাইছেন!

দু’বছরের মাথায় দেশের চালচিত্র একটু পাল্টাল। ১৯৬৬-৬৭। শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খাদ্যাভাব, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই। বেকারি চরমে। জনসাধারণের ক্ষোভ তুঙ্গে। রাজ্য তথা দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের ওজন কমছে। সিপিএম নতুন অঙ্ক কষল। ১৯৬৭-র নির্বাচনে কেরলে মুসলিম লিগের সঙ্গে ‘স্থায়ী’ মৈত্রী গড়ে ‘স্থায়ী জোট সরকার’ গঠন করল, মাদ্রাজে ডিএমকে-র নেতৃত্বে গঠিত জোটে স্বতন্ত্র পার্টি, মুসলিম লিগ, পিএসপি, এসএসপি-র সঙ্গে যোগ ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ময়দানে বিরোধিতা করলেও, সিপিএম ভোটের পরে বাংলা কংগ্রেস সহ নানা বর্ণের দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করে। এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বাংলা কংগ্রেসের নেতা, কংগ্রেস-ছুট অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, যিনি আগের বছর পর্যন্ত কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন। যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শের সঙ্গে মূল কংগ্রেসের তেমন কিছু তফাত ছিল না।

এই সব সঙ্গী নির্বাচনে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণিবিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি পার্টির ভিতরের ও বাইরের বহুজনের সমালোচনা কুড়িয়েছিল, কিন্তু ক্ষীয়মাণ কংগ্রেসের শূন্যস্থান পূরণ করে চালু সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকে স্থায়িত্ব দানে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। স্বতন্ত্র পার্টি, মুসলিম লিগ, জনসঙ্ঘ, বাংলা কংগ্রেস, পিএসপি ইত্যাদি ‘গণতান্ত্রিক দল ও গোষ্ঠী’গুলির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সিপিএম ‘জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার উপর’ শাসকশ্রেণির আক্রমণকে কেমন প্রতিহত করেছিল ও ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক নতুন অধ্যায়’ রচনা করেছিল, তা তো আমাদের জানা। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।

১৯৬৮-তে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সুন্দরাইয়া বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রধান শত্রু কংগ্রেসকে হারাবার জন্য জনসঙ্ঘের (যার বর্তমান নাম বিজেপি) সঙ্গে হাত মেলাতে আমরা প্রস্তুত।’ পরে বিভিন্ন সময়ে পার্টি কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে, আবার ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল’দের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে!

১৯৬৯-এ কংগ্রেসের উচ্চতম মহলে তীব্র লড়াইয়ের সময় সিপিএম ইন্দিরা গাঁধীর মধ্যে প্রগতিশীলতা আবিষ্কার করে। সমর্থন করে ভি ভি গিরিকে। গিরির জয়ে পশ্চিমবঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা এক দিনের ছুটি ঘোষণা করেছিল। সিপিএম পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে গিরির জয়কে ‘জনগণের ও প্রগতিশীল শক্তিদের জয়’ বলে অভিনন্দিত করেছিল। এর পরেই সিপিএম আবার ১৯৬৯-এ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার মধ্যবর্তী ভোটে বাংলা কংগ্রেস, পিএসপি, গোর্খা লিগ, লোকসেবক সংঘ ইত্যাদি হরেক রকম দলের সঙ্গে কংগ্রেস-বিরোধী জোট গড়ল। জোট জিতল। রাজ্যে গঠিত হল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিছু দিন পর, পূর্বের মতোই ১৯৭০-এর মার্চের মাঝামাঝি আবার তা ভেঙেও গেল।

এই ১৯৭০-৭৩ সময়ে ইন্দিরা কংগ্রেস সম্পর্কে সিপিএম তাদের মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, ‘ইন্দিরা কংগ্রেসের মধ্যে রয়েছে একটি সুস্থ ঝোঁক, যা বৃহৎ জমিদার ও একচেটিয়াদের ঘৃণা করে।’ তারা বলছে, ‘সিপিএম কখনও এ কথা বলেনি যে, কংগ্রেসের মধ্যে কোনও গণতান্ত্রিক শক্তি নেই।’ এই কথা বলার সময়ে তারা রাজ্যে পুলিশ-মিলিটারির নির্বিচার বেআইনি হত্যাক্রীড়া দেখছে! রাজ্যে ১৯৭১, ১৯৭২-এর নির্বাচন চোখের সামনে দেখছে। পরেও তাদের কংগ্রেস তথা ইন্দিরা গাঁধীপ্রীতি খুব একটা কমেনি। হয়তো প্রধানমন্ত্রী তা মনেও রেখেছেন। ‘গণতান্ত্রিক’ ইন্দিরা গাঁধী ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি করে বহু দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলেও ভোটপন্থী লালপার্টি সিপিএম নিষিদ্ধ হয়নি। তার স্পষ্টবক্তা সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু গ্রেফতার হন, গণশক্তির একটি (ওই একটিই) সংখ্যা বাজেয়াপ্ত হয়, কিন্তু দল নিষিদ্ধ হয়নি।

১৯৮৯-এর নির্বাচনে অন্ধ্রপ্রদেশে তেলুগু দেশম পার্টির নেতৃত্বে যে আসন-রফা হয়, তাতে সিপিএম, সিপিআই এবং বিজেপি-র ভাগে পড়েছিল দু’টি করে আসন। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র নেতৃত্বে আসন-রফায় সিপিএম এবং মুসলিম লিগ ছিল। এই নির্বাচনের পরে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সমর্থনে সিপিএম ও বিজেপির হাত মেলানোর ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত।

এর কিছু কাল পরেই আবার দেখা গেল, সিপিএমের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের ভালবাসা পাবার উদ্যোগ। কংগ্রেসকে মধ্যমণি করে সমাজবাদী পার্টি প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তাদের নীতি হয়ে দাঁড়াল কংগ্রেসকে সমর্থন এবং বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট যাতে ভাগ না হয়, তা দেখা। জ্যোতি বসু বললেন, সনিয়া গাঁধীর মূল্যায়ন করবার সময় মনে রাখতে হবে কংগ্রেসকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর মূল্যবান ভূমিকার কথা। ২০০৪-এ সিপিএম কংগ্রেস চালিত ইউপিএ-কে সমর্থন করল, আবার ২০০৮-এ আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির শর্ত পছন্দ না হওয়ায় তা প্রত্যাহারও করল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য বলেছিলেন, তাঁরা সমর্থন তুলে নিলেই কংগ্রেস ‘ধপ করে’ পড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হল না, কংগ্রেসই রয়ে গেল তখন।

এক বছরের কিছু আগে সাংসদ নির্বাচনে এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যত হুঙ্কার ছেড়েছে সিপিএম, তত কুবচন বিজেপি-র বিরুদ্ধে বলেনি। এবং বিজেপি দখল নিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার। কংগ্রেস তার নীতির কিছুমাত্র পরিবর্তন না করলেও এখন আবার সিপিএম তাদের দিকে ঝুঁকছে। অন্তত আমাদের রাজ্যে এই লালপার্টির ভাবগতিক সেই রকম।

মোদ্দা কথাটা এই যে, ভোটে অংশ নিয়ে জনতাকে সচেতন করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের পথে টেনে আনবার যে তত্ত্ব লেনিন উপস্থাপনা করেছিলেন সেই রাস্তায়, অথবা লেনিন সহধর্মিণী নাদিয়েজ্দা ক্রুপস্কায়া বর্ণিত বিপ্লবের ‘মহান গম্ভীর সৌন্দর্য’ উপভোগ করবার পথে সিপিএম আগেও ছিল না, আজও নেই। অভিজ্ঞতা বলে, বিভিন্ন ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে তারা শাসনক্ষমতা উপভোগ করতে চায়। অতএব, এখন কংগ্রেসের হাত ধরতে বাহাদুরির কিছু নেই, লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE