Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
যুক্তির জোরে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলার স্বর, কম কথা নয়

নব্বই দিনে নিঃশব্দ বিপ্লব

তিন মাস পরে হায়দরাবাদের এম বাসবপুন্নাইয়া ভবনে তাঁর কাছেই অনবরত ফোন আর মেসেজ আসছে। তিনি পারলেন তা হলে! চেহারায় স্বস্তি, কথায় আরও বেশি আত্মবিশ্বাস।

প্রত্যয়: দলের সহনায়কদের সঙ্গে সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। হায়দরাবাদ, ১৮ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই

প্রত্যয়: দলের সহনায়কদের সঙ্গে সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। হায়দরাবাদ, ১৮ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই

সন্দীপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১১:৩৫
Share: Save:

সেই দিনটা পরিষ্কার মনে আছে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে মুজফ্‌ফর আহমেদ পাঠাগারের পাশের ঘর। উড়়ান ধরতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সামান্য বিরতি নিতে ঢুকেছেন তিনি। কিন্তু নিস্তার কই! বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের একের পর এক বুম ঢুকে পড়়ছে ‘বাইট’ নিতে! কিছু ক্ষণ আগে কেন্দ্রীয় কমিটির ভোটে খারিজ হয়ে গিয়েছে তাঁর রাজনৈতিক প্রস্তাব। বৈঠকের ভিতরে তিনি নিজেও ইস্তফা দিতে চেয়েছেন। তবু বাইরে বেরিয়ে বুকে পাথর এবং মুখে হাসি নিয়ে তাঁকেই দলের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে সংবাদমাধ্যমের সামনে। তার পরে বিরতিতেও প্রশ্ন চলছে: কম সংখ্যা নিয়ে তিনি কি পারবেন দলের লাইনে পরিবর্তন আনতে?

তিন মাস পরে হায়দরাবাদের এম বাসবপুন্নাইয়া ভবনে তাঁর কাছেই অনবরত ফোন আর মেসেজ আসছে। তিনি পারলেন তা হলে! চেহারায় স্বস্তি, কথায় আরও বেশি আত্মবিশ্বাস। হাসিমুখেই তিনি জবাব দিয়ে চলেছেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক কাঠামোকে রক্ষা করার সংগ্রামে ঝাঁপাতে হবে।

আত্মবিশ্বাসী ভদ্রলোকের নাম সীতারাম ইয়েচুরি! জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, এই তিন মাসের মধ্যে তাঁর হাত ধরে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আকাশে একটা উড়ান নিয়েছে সিপিএম। আবহাওয়ার বিভ্রাটে পড়েছে, এয়ার পকেট এসেছে। ভিতরে ওলটপালট হয়েছে অনেক কিছু। তার পরে হায়দরাবাদে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে অবতরণ করেছেন পাইলট! যা দেখে চমকিত এবং আশ্বস্ত হয়েছে গোটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নানা রাজনৈতিক শক্তি। বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা করে সংখ্যালঘুর মত তাঁর দলে সংখ্যাগুরুর স্বীকৃতি আদায় করে ছেড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির কেতাব-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে ঝাঁকুনি দিতে যুক্তির জাল বুনেছেন পঞ্জাব থেকে তামিলনাড়়ু, মহারাষ্ট্র থেকে বাংলার প্রতিনিধিরা। যুক্তির জোরে সংখ্যার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে দেশের রাজনীতির বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে পার্টি কংগ্রেসে।

এই বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে যখন শুধু হিংসা আর রক্তের ছবি, সেই সময়েই কেতাব থেকে বাস্তবের দিকে একটা দলের এই অভ্যন্তরীণ যাত্রাপথ সমীহ জাগায় বইকি! সমীহ জাগায়, কারণ ক্ষমতাসীন পক্ষের চোখরাঙানি দেখতে অভ্যস্ত এই পোড়়া দেশের মানুষের কাছে সে বিশ্বাসটাই প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে যে, যুক্তি, যুক্তি, শুধুই যুক্তির হাতিয়ারে এমন লড়়াই লড়়া এবং জেতা যায়! কৃতিত্ব ইয়েচুরির বটেই। মগজের জোরে আসমুদ্রহিমাচল সিপিএমের সমর্থন তিনি আদায় করেছেন। কিন্তু বাহবা দিতে হবে প্রকাশ কারাটকেও। যুক্তির কাছেই তিনি শেষ পর্যন্ত জেদ বিসর্জন দিয়েছেন। মেনে নিয়েছেন, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু মত থাকে। কিন্তু বিতর্ক চালিয়ে একটা মতে পৌঁছলে সেটাই দলের মত হয়ে দাঁড়়ায়।

কমিউনিস্ট পার্টিতে দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অভিমুখ ঠিক করার জন্য তিন বছর অন্তর পার্টি কংগ্রেস হয়েই থাকে। কিন্তু ২০১৮-র হায়দরাবাদ এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে রইল! সিপিএমের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে এখনও জীবিত যে দু’জন, তাঁদের অন্যতম ভি এস অচ্যুতানন্দনের মুখে যদি শুনি, ‘‘আমরা ১৯৬৪ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম একটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে। এই ২২তম পার্টি কংগ্রেসের পরে মনে হচ্ছে, সেই ইচ্ছেটা মরে যায়নি! এত জীবন্ত একটা বিতর্ক হল। এই ৯৪ বছর বয়সেও আমি সঙ্ঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী কর্মসূচির বিরুদ্ধে আমাদের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কাজ করতে তৈরি!’’

একটা দলে গণতন্ত্র মেনে একটা প্রক্রিয়া দেখতে দেখতে যদি প্রশ্ন করি, কী এমন হল এই পার্টি কংগ্রেসে, যা সাম্প্রতিক কালে হয়নি? উত্তরটা তা হলে তিন ভাগে ভেঙে নিতে হবে।

প্রথমত, ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিংহ সুরজিতেরা দলটাকে শুধু মাঠে-ময়দানের সংগ্রাম থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে টেনে এনেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, যে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, সেখানে সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামই শেষ কথা হতে পারে না। তার পরে সিপিএম সেই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছে, তিন রাজ্যে ক্ষমতায় গিয়েছে, কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট ধাঁচের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের পথের দাবি মেনে দলটাকে চালাব কি না, এই সংশয় থেকে সিপিএম কিছুতেই বেরোতে পারেনি! বিভিন্ন পার্টি কংগ্রেসে তা বার বার প্রমাণিত। এ বার অন্তত তার ব্যতিক্রম হয়েছে। বিজেপি সাঙ্ঘাতিক বিপদ এবং এই মুহূর্তে মহা শক্তিশালী, নিজেদের সীমিত এবং ক্রমক্ষীয়মাণ শক্তিতে তাদের মোকাবিলা সম্ভব নয়, বৃহত্তর এবং অভিন্ন বিপদের মোকাবিলায় তাই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সব বিরোধী শক্তিকে যুক্তফ্রন্টের সূত্রে কাছাকাছি আসতে হবে— লড়াইয়ের এই সহজ শর্ত এ বার পার্টি কংগ্রেসে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে। কেতাবি, কট্টরপন্থী কিছু বাম নেতা এখনও ইয়েচুরিকে গাল পাড়বেন ‘সংসদীয় বিচ্যুতি’র অভিযোগ এনে! কিন্তু তাতে গণতন্ত্রের বাস্তব বদলাবে না। সেই বাস্তবকেই এ বার স্বীকার করা হয়েছে হায়দরাবাদে।

দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নামক ধর্মটির অপপ্রয়োগের দোষে দুষ্ট একটা দল এমন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিতর্ক চালিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছে, এই নজিরও গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে স্বস্তিদায়ক। কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটা দলিল, একটা মত খারিজ হয়ে গিয়েছে মানে সিপিএমে কেউ আর কোনও আশা রাখেনি কোনও দিন! কিন্তু তিনি, রাজ্যসভায় সংখ্যালঘু পক্ষের হয়েই মারকাটারি বিতর্ক চালিয়ে আসা ইয়েচুরি, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েননি। কলকাতার সেই কেন্দ্রীয় কমিটি আর হায়দরাবাদের পার্টি কংগ্রেসের মাঝের তিন মাসে এক এক করে পনেরোটা রাজ্যের দলীয় সম্মেলনে নিজে হাজির হয়েছেন। কোথায় কাশ্মীর, কোথায় হিমাচল, কোথায় ওডিশা, কোথায় তামিলনাড়়ু— একের পর এক প্রান্তে গিয়েছেন এবং বুঝিয়েছেন আরএসএস-এর রাজনীতি কত বড়় বিপদ। নানা রাজ্যের অসংখ্য সাধারণ নেতা-কর্মী ইয়েচুরির যুক্তি শুনেছেন এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়েছেন। তার পরে তাঁরা প্রায় আট হাজার সংশোধনী পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির পাশ করা খসড়ার উপরে। তার মধ্যে বেশ কিছু সংশোধনীর দাবি শুধু একটা বাক্যই: যে অনুচ্ছেদে লেখা আছে, কংগ্রেসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সমঝোতা চলবে না, সেই অনুচ্ছেদটা বাদ দেওয়া হোক! যে কেন্দ্রীয় কমিটি ভোটে খারিজ করেছে ইয়েচুরির মত, বিপুল সংশোধনীর ধাক্কায় সেই কমিটিই আবার খারিজ হওয়া মত পার্টি কংগ্রেসে উত্থাপন করতে বলছে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের পথে প্রথম বিপ্লবটা ওখানেই করে ফেলেছেন নামগোত্রহীন অজস্র সিপিএম কর্মী! পাঁচ দিনে বাকিটা তো ইতিহাস!

তৃতীয়ত, পার্টি কংগ্রেস চিরকাল দেখে এসেছে কেরলের নেতৃত্বে দক্ষিণী লবির আধিপত্য। বাংলায় দলের দাপটের দিনেও। কিন্তু সেই বাংলা নিজেদের চলার পথে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যে পথ খুঁড়ে বার করেছিল, তারই পক্ষে দাঁড়িয়েছে এই পার্টি কংগ্রেস। যুক্তির জোরে বাংলার স্বর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা মঞ্চের কাছাকাছি বসে বাঙালি সংবাদলিখিয়ের শিরাতেও শিহরন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Party Congress politics Sitaram Yechurya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE