Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

হনুমানের মজাটা চলে গেল, শাস্ত্র হয়ে উঠল অস্ত্র

রা জশেখর বসুর দৌলতে বাঙালি পরশুরাম পুরাণসিদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর কলমে পুরাণ হয়ে উঠত একেবারে অধুনা। সবার সংকটমোচনকারী বীর হনুমানের সংকটকথা এই জম্বুদ্বীপে একমাত্র তিনিই লিখতে পেরেছিলেন, তা-ও আবার বাংলা গদ্যে।

গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৮
Share: Save:

রা জশেখর বসুর দৌলতে বাঙালি পরশুরাম পুরাণসিদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর কলমে পুরাণ হয়ে উঠত একেবারে অধুনা। সবার সংকটমোচনকারী বীর হনুমানের সংকটকথা এই জম্বুদ্বীপে একমাত্র তিনিই লিখতে পেরেছিলেন, তা-ও আবার বাংলা গদ্যে। হনুমানের ইচ্ছে সামান্য, পিতৃগণের পিণ্ডদানের জন্য অকৃতদার বৃদ্ধ হনুমান কোনও এক যোগ্যা হনুমতীকে পুত্রার্থে বিয়ে করতে চান, সংসার প্রেমও আকাঙ্ক্ষা করেন। দেবচরিত্র থেকে কাকচরিত্র তাঁর নখদর্পণে, যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারে সাফল্য পেতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার, সাগর লাফানো, লঙ্কা পোড়ানো বা ওষুধ আনতে গিয়ে গোটা গন্ধমাদন তুলে আনার মতো কাজ তো তাঁর কাছে নস্যি। অথচ ‘কোমলাঙ্গী মসৃণবদনী পয়স্বিনী শিশুপালিনী’ ভার্যার সঙ্গে কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেই বিধিশাস্ত্রে তিনি ‘ক’ অক্ষর গোমাংস। চেষ্টা সত্ত্বেও হনুমতীর জন্য অভিযানে তিনি সফল হননি, কাণ্ডগুণে তাঁর খামতি ছিল। তবে নিছক বীর ও রৌদ্রগুণের দাপটে তিনি সুন্দরী অথচ দুর্বিনীতা বানরী চিলিম্পাকে ঢিট করে বহুবল্লভ সুগ্রীবকেই দান করেন। ভক্ত বীর হনুমান কথায় দাম্পত্য প্রেম জায়গা পেল না, হনুমান চিরজীবী ও চিরকুমার হয়ে নিজেই পিতৃঋণ শোধ করতে লাগলেন, বউ আর পেলেন না। চুলোচুলির রস বিমুক্ত দাম্পত্য-প্রেম দুর্লভ, বোধ হয় পানসেও। সমতা ও ক্ষমতার একশো ভাগ ভারসাম্য রাখা আজও স্বপ্ন, স্বয়ং হনুমানের কাছে, ও আমাদের কাছেও।

চৈত্র মাসে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর পুণ্য শুক্লপক্ষে হনুমানের বঙ্গীয় মাহাত্ম্যগাথা শুনে বারাণসীর বিখ্যাত স্বামীনাথ আখড়ার কাল্লু পহলবান একটুও বিচলিত হতেন না। কুস্তিগীরদের সর্বোচ্চ দেবতা হনুমান। সুগ্রীবও বলশালী ছিল। বালী তো একাই রাবণকে সাতসমুদ্রে চুবিয়ে আনতে পারত। কিন্তু হনুমানই শেষপর্যন্ত রামের কাজ সম্পাদন করেছিলেন, কারণ তিনি ব্রহ্মচারী, সংযমী। তাই হনুমান-চালিসায় রামের কাছে মারুতি ভাই ভরতের মতো প্রিয়, রাম তাঁকে বার বার জড়িয়ে ধরেন, রামদাস হয়ে যান রামসখা। তুলসী দাস তো লিখেই গেছেন, ‘রাম তে অধিক রাম কর দাসা।’ রামচন্দ্রের প্রসাদেই বোধ হয় যে কেউ হনুমান জয়ন্তী একেবারে কার্তিক মাসের যক্ষ অমাবস্যাতেও করতে পারে, অযোধ্যার হনুমানগড়ের মোহন্তরা মনে করেন সেটাই প্রশস্ত, ভূত-প্রেত-যক্ষ-রক্ষ সব হাতের মুঠোয় থাকবে।

শক্তি ও ভক্তি তো অচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত, শক্তি না থাকলে কি কেউ কানাকড়ি ভক্তি করে? কোনটার জোর কখন বেশি, মুখটা কোন দিকে কতটুকু ফেরানো, তা নির্ভর করে দৈনন্দিন জীবনযাপনে নিত্য ও নৈমিত্তিকের টানাপড়েনে, সামাজিক পোষকতার চরিত্রে, কথন ও পঠনের রুচির ভেদে। যেমন, বাঙালি গৃহস্থের ঘরোয়া রুচির তাগিদে ও নানা টুকরো গল্পের জড়াপট্টিতে কৃত্তিবাসের দেব হনুমান ভয়ানক কর্মকুশলী, মহীরাবণের পূর্ণ গর্ভবতী মহারানির পেট লাথি মেরে ফাটিয়ে দেন, পেট থেকে খসে পড়া অহীরাবণকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলেন। আবার ছদ্মবেশে শুভার্থী বামুন সেজে তিনিই মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হাতান।

এই সব কর্ম সত্ত্বেও কৃত্তিবাসী হনুমান আকারে-প্রকারে হাসান, তাঁর বীরপনার সঙ্গে দুষ্টুমির আমেজও মেশানো। গত শতকের বাংলার সাহিত্যিক উপস্থাপনায় এই মজারু হনুমানই যেন বেশি বেশি করে হাজিরা দিয়েছে, যেমন, উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও রেখায়, সুকুমার রায়ের নাটকের সংলাপে বা অবনঠাকুরের মারুতির পুঁথিতে, ভোজনপ্রিয় হনুমানের বৈষ্ণবীয় খাদ্যের ফিরিস্তিতে, ‘লুচি মালপোয়া তেলে ঘৃতেতে ছাঁকিয়া, বার্তাকু ভাজহ তাহে তিল বড়ি দিয়া। চোঁয়া চোঁয়া করে ভাজ উচ্ছে কড়কড়ি, গুড়চিনি একত্রেতে তাজা ফুলবড়ি।’ মুসলমানি পুঁথিতে তো অকৃত্রিম পালোয়ান হনুমান খলিফা বীর আলির প্রতিস্পর্ধী, অযোধ্যার মন্দিরের উপরে দুজনে কুস্তি লড়েই যান, ‘এতেক কহিল যদি আলী পালোয়ান, গোস্বায় জ্বলিয়া গেল বীর হনুমান’। লড়াই অমীমাংসিত থাকে, সমঝোতা হয়, আলি ও হনুমান এক জন আর এক জনের তারিফদার বন্ধু হন। আদালতের মাননীয় বেঞ্চ পুঁথিটা এক বার পড়লে পারেন, রামজন্মভূমি মামলাটার সমাধান বেরোতেই পারে, আলোচনাতেই তো সব হয়।

মার্গ থেকে দেশজ, দরবারি থেকে বাজারি হনুমানের ভক্তি ও শক্তির কথা— পরম্পরার ছোট-বড় অনেক সুতো সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে, নানা রঙে ছোপানো, একটা-দুটোকে বেছে ভালমত টান দেওয়াটাই রাজনীতির খেলা। রংটা সহজিয়া না জেহাদি, সেই বাছাটাই তো ওস্তাদ খেলুড়ের কাজ। ১৯৭০-এর দশকের শেষে ভারতীয় সংসদে মানী সদস্য বুকে প্ল্যাকার্ড সাঁটিয়ে এসেছিলেন, তাতে লেখা, ‘আমি চরণ সিংহের হনুমান।’ হাস্যরোলের মধ্যেও বার্তা বুঝতে কারও সে দিন অসুবিধে হয়নি। ১৯৯০’তে ওই দিল্লি শহরের বসন্ত গ্রামে প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারী বিশাল এক হনুমানের মূর্তিকে দিল্লির দ্বারপাল বলে প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বাস, পাকিস্তান আর ভারত আক্রমণ করতে ভরসা পাবে না।

গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংকটমোচন হনুমানের পূজা মূলত চলত গ্রাম-শহরের ঘর-গেরস্থালিতে। গ্রহকোপে পড়া পরিবারে স্বস্ত্যয়নের জন্য আদ্যন্ত পড়া হত রামায়ণের সুন্দরকাণ্ড। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে বারাণসীর নানা মহল্লাতেই নিদেনপক্ষে তিন হাজার থেকে চার হাজার নানা আকার-প্রকারের হনুমান স্বয়ম্ভূ হিসাবে জাগ্রত হয়েছেন। ওই কালপর্বেই তুলসী ঘাটের মাঝারি আকারের সংকটমোচন মন্দির আয়তনে তিন গুণ হয়ে উঠেছে, বজরঙ্গবলীদের ভিড় লেগেই আছে। ১৯৯৮ সালেই হরবংশলাল মিশ্র ‘সংকটমোচন হনুমান চরিত মানস’ বলে একেবারে দেশজ ইংরেজিতে আটশো ষোলো পৃষ্ঠার বই লিখে ছাপান। তাঁর অন্যতম প্রতিপাদ্য, হোমিয়োপ্যাথির আদি পুরুষ হানিমান হনুমানের সাক্ষাৎ শিষ্য, সর্বরোগহর হাল আমলের বিদ্যেটা তিনি অমর গুরুজির কৃপাতেই পেয়েছেন। ভক্তির ভিত ধনবল, বাহুবল ও জ্ঞানবলে পোক্ত হয়ে উঠেছে।

অতিকথা, অর্বাচীন স্মৃতিপ্রসঙ্গ, কথাকণিকা— সব মিলিয়েই অতীতের মায়াদর্পণটি তৈরি হয়, ওই মায়াদর্পণেই বর্তমান নিজেকে দেখে, ভবিষ্যতের রূপ প্রক্ষেপ করে। আধুনিকতার যুক্তিতে সেরা স্মার্ট বাজার সাউথ সিটি মলের ঠিক পাশে পোদ্দারনগরে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ছোট মন্দিরে এ বার গদাধারী হনুমানের জয়ন্তী সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। অধুনার যুক্তির দাবিতেই ভক্তির পরিসরের পুনর্বিন্যাস বুঝতে হবে, ধরতে হবে পলকে শাস্তর কী করে অস্তর হয়। এই রূপান্তরের জেরে ছেলেবেলায় চেনা মজার হনুমানটা হঠাৎ হারিয়ে যায়। সে বেচারা কলাও আর খেতে আসে না, জয় জগন্নাথও দেখতে চায় না। কোনও স্বৈরাচারী দাপুটে শাসকই তো হাসি সহ্য করতে পারে না, হাস্যরস তো ভাবের বিপর্যাস।

শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hanuman Jayanti Current trend
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE