পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভর্ৎসনা: বাঙালি সমাজের একাংশ অহেতুক বাঙালির বদনাম করে, বাংলার মহিমা লইয়া গর্ববোধ করে না। তাঁহার কথা এবং সুর শুনিয়া মনে হয়, তিনি ইহাতে ক্ষুব্ধ। মনের অভিলাষ পূর্ণ না হইলে মানুষ ক্ষুব্ধ হইতেই পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর অভিলাষ হয়তো ইহাই যে, সমস্ত রাজ্যবাসী সকালে ঘুম ভাঙিবার পর হইতে রাত্রে নিদ্রামগ্ন হওয়া অবধি— পারিলে স্বপ্নেও— পশ্চিমবঙ্গের সুনাম করিবেন, নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারায় স্নান করিয়া বলিবেন, ‘আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল।’ মহতী ইচ্ছা, সন্দেহ নাই। কিন্তু একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। সকলেই যদি সর্বদা ‘মন্দ দেখিব না, মন্দ শুনিব না, মন্দ বলিব না’ ভাবিয়া চোখ কান এবং মুখ বন্ধ করিয়া পরিতৃপ্ত থাকে, তবে সমাজের সমস্যাগুলির কথা বলিবে কে, আর না বলিলে সেই সব সমস্যা মোকাবিলার তাগিদই বা জন্মাইবে কেন?
মুখ্যমন্ত্রী হয়তো পত্রপাঠ জবাব দিবেন যে, তিনি রাজ্যের সমস্ত অধিবাসীর সকল সমস্যা সম্পর্কে সর্বদা সম্পূর্ণ অবহিত এবং তাহাদের সমাধানের জন্য অহোরাত্র শতকরা একশো ভাগ চেষ্টা করিতেছেন, অন্যদের মাথা ঘামাইবার কী বা প্রয়োজন? অতীতে রাজা-বাদশাহেরা এমন বলিতেন বটে, কিন্তু ইদানীং যে শাসনব্যবস্থা চলিতেছে, তাহার নাম গণতন্ত্র। সেখানে নাগরিকরা— প্রজা নহে, নাগরিক— অভাব অভিযোগ বলিতে পারেন, প্রতিকারের দাবি জানাইতে পারেন। বস্তুত, বিরোধী রাজনীতিক, সচেতন নাগরিক সমাজ, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি বিবিধ প্রতিষ্ঠান নিরন্তর নির্বাচিত সরকারের দোষ, ত্রুটি, অক্ষমতা বা দুর্নীতির সন্ধান করিয়া জনসমক্ষে পেশ করিবেন, শাসকদের উপর আত্মসংশোধনের জন্য তীব্র চাপ সৃষ্টি করিবেন, তবেই গণতন্ত্র সার্থক, নচেৎ তাহা নিছক পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনে বোতাম টিপিবার আচারে পর্যবসিত হয়, সেই আচারসর্বস্বতাকে ভোটতন্ত্র বলা চলিতে পারে, গণতন্ত্র নহে। গণতন্ত্রের প্রকৃত পরীক্ষা একটি নির্বাচন এবং পরবর্তী নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে।
সম্প্রতি তেমনই একটি পরীক্ষা আয়োজিত হইয়াছে ঝাড়গ্রাম জেলার কিছু দারিদ্রপীড়িত এলাকায়। সেখানে, বিশেষত শবরদের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক সঙ্কটের মর্মান্তিক বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে। যে কোনও সরকারের পক্ষে এমন বিবরণ অস্বস্তিকর, কারণ তাহাতে সরকারি ঔদাসীন্য বা অপদার্থতার স্বরূপ সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। সেই স্বরূপ উন্মোচিত হইলে সরকারি উষ্মাও অস্বাভাবিক নহে। চৌদ্দ বৎসর পূর্বে তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার আমলাশোলে একই ধরনের দুর্দশার বিবরণ লইয়া ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারও বিস্তর রাগ দেখাইয়াছিল। তাহারা সংবাদপত্রের রিপোর্টকে অসত্য বলিয়াছিল। বর্তমান প্রশাসনও সাংবাদিকের বিবরণকে অসত্য বলিয়া অভিযোগ করিয়াছে, সাংবাদিক তাহার উত্তরও দিয়াছেন— গণতান্ত্রিক বিতর্কের রীতি অনুসারেই। কিন্তু সওয়াল-জবাব ও আনুষঙ্গিক টানাপড়েনের পাশাপাশি আর একটি কাহিনিও রচিত হইতেছে। গত এক সপ্তাহে শবরদের দুর্দশার প্রতিকারে প্রশাসনের মনোযোগ ও তৎপরতা রীতিমতো চোখে পড়িতেছে। উদ্যম স্থায়ী হইবে কি না, বলা শক্ত। কিন্তু অন্তত সাময়িক ভাবেও সরকার যে দরিদ্রের প্রতি নজর দিয়াছে, তাহার মূল্য কম নহে। এবং, এই পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, কেহ যেন অনাহারে না থাকে, তাহা দেখিতে হইবে। এই মনোযোগ, এই তৎপরতা যদি সংবাদপত্রের বিবরণের প্রতিক্রিয়া হয়, তবে বুঝিতে হইবে, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র এখনও সম্পূর্ণ অচল হয় নাই। অপ্রিয় সংবাদ প্রকাশিত হইলে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ দেখাইতে চাহেন দেখান, তাঁহার সরকার সংবাদের সত্যতা অস্বীকার করিতে চাহে করুক, কিন্তু সংবাদের তাড়নায় দরিদ্রের কুটিরে সরকারি সাহায্য পৌঁছাইতেছে, ইহাই আসল কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy