Advertisement
২১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কাকে বলে দেশপ্রেমী

কা  লাপানির সাজাপ্রাপ্ত, আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে বিনায়ক দামোদর সাভারকরই কি শ্রেষ্ঠ ছিলেন?

বীর?: কলকাতায় হিন্দু মহাসভার নেতাদের সঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকর (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)।

বীর?: কলকাতায় হিন্দু মহাসভার নেতাদের সঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকর (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)।

জহর সরকার
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৭ ১১:৪০
Share: Save:

কা  লাপানির সাজাপ্রাপ্ত, আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে বিনায়ক দামোদর সাভারকরই কি শ্রেষ্ঠ ছিলেন? একই সাজায় দণ্ডিত বাঙালি স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা কি সাভারকরের দেশপ্রেম বা সাহসিকতার তুলনায় কম কিছু ছিলেন? ট্যুরিস্টদের সেলুলার জেল দেখানোর সময় শ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্য হিসেবে তুলে ধরা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’তে যে ভাবে পুরো গুরুত্বটাই কেবল সাভারকরকে দেওয়া হয়, এবং বাঙালি বা অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তা মোটেই দেওয়া হয় না, তা দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। এই বিষয় নিয়েই সম্প্রতি লোকসভায় তর্ক হয়েছে। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছবার আগে এবং ‘এটা ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিকৃতি’ কিংবা ‘যে মানুষটা ইংরেজদের সঙ্গে আপস করে নিজের মুক্তি আদায় করেছিলেন, তাঁকে দেবত্ব বা বীরত্ব আরোপ করা অনুচিত’ গোছের মন্তব্য করার আগে ইতিহাসের সত্যটা আবেগহীন ভাবে যাচাই করা দরকার।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরাজ যখন ‘বিপজ্জনক যুদ্ধবন্দি’দের তড়িঘড়ি বহু দূরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত রস দ্বীপের মতো জায়গাগুলিতে চালান করে দেয়, তখনও সেলুলার জেল তৈরি হয়নি। ১৮৬৮ সালের মার্চ মাসে ২৩৮ জন বন্দি পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সবাই ধরা পড়ে যান এবং এঁদের মধ্যে ৮৭ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এঁদেরও তা হলে স্মরণ করা উচিত নয় কি? এই সব ঘটনার বহু পরে সেলুলার জেল। তার নির্মাণ শেষ হয় ১৯০৬ সালে। জেলের নির্জন একাকী কুঠুরিগুলো তৈরি করা হয়েছিল, যাতে এই নিঃসঙ্গ কারাবাস বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনের জোর, দেশপ্রেমের তেজ, গুঁড়িয়ে দিতে পারে। অবশ্য এ ব্যবস্থা সাভারকরের মতো কয়েক জন ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে তেমন কাজ দেয়নি।

সেলুলার জেল দেখতে গিয়ে সেখানকার নথিপত্র থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। সেখানকার রাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে অবিভক্ত বাংলার মানুষ ছিলেন সবচেয়ে বেশি, ২৮৩ জন। এর পরেই স্থান পায় ইউনাইটেড প্রভিন্স (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড) ও পঞ্জাব: বন্দির সংখ্যা যথাক্রমে ৮১ ও ৭৫। টিলক এবং গোখলের সময় থেকেই মহারাষ্ট্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে থেকেছে, কিন্তু সেখান থেকে দ্বীপান্তরীর সংখ্যা মাত্র ৩৯। না, এখানে আমরা দেশপ্রেমের তুল্যমূল্য বিচার করতে বসিনি, যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে এখন সেটাই একটা ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই জেলে বেশ বিশিষ্ট কিছু বন্দি ছিলেন। যেমন ফজ‌্ল-এ-হক খয়রাবাদি, যিনি ১৮৫৭’র বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। প্রথম যাঁদের দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়, ইনি ছিলেন তাঁদেরই এক জন। ১৮৬১ সালে ওখানেই তিনি মারা যান। প্রথম দফায় যে ৩০৯ জন বন্দি আন্দামানে যান, তাঁদের মধ্যে সংখ্যায় অর্ধেক বা তারও বেশি ছিলেন মুসলমান বন্দি। মৌলবি লিয়াকত আলির মতো নেতা থেকে কাল্লু মিয়াঁর মতো সাধারণ সেপাই অবধি। এঁরা কেউই হয়তো ‘দেশপ্রেমী’ হওয়ার প্রমাণ দাখিল করতে পারবেন না। সাভারকর নিশ্চয়ই এক জন তারকা, কিন্তু বটুকেশ্বর দত্ত এবং যোগেন্দ্র শুক্ল, যিনি ভগৎ সিংহের নিকট সহচর বলে বিশেষ পরিচিত, তাঁরাও কম উজ্জ্বল ছিলেন না। পঞ্জাবের গদর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ভাই প্রেমচাঁদ, যিনি প্রথম লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হন, তিনিও যেমন এই জেলে নির্বাসিত হয়েছিলেন তেমনই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দায়ে অভিযুক্ত অনন্ত সিংহ এবং গণেশ ঘোষও এই জেলেই বন্দি ছিলেন। এঁদের সহবন্দি ছিলেন সাভারকরের ভাই, বাবারাও।

আর তাই, সাভারকর-সর্বস্ব কথনটিকে সংশোধন করা দরকার। খেয়াল করা দরকার, তাঁকে দ্বীপান্তরের সেরা বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরটি তাঁর নামেই উৎসর্গ করেন। অথচ ঘটনা হল, তাঁর কয়েকশো সহবন্দি যখন অমানবিক পরিবেশে অন্যায় দণ্ড ভোগ করেছিলেন সাহসের সঙ্গে, ‘বীর’ সাভারকর তখন বার বার মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেছেন! এই তথ্য রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব প্রকাশনাতেই। ‘হিন্দু মনোভাবে’-এর প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত সরকারি ইতিহাসে উদ্ধৃত হয়েছে ১৯১৩ সালে সাভারকরের ক্ষমাপ্রার্থনা: পরম দয়ালু ব্রিটিশ সরকার যদি আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন, তা হলে আমি ইংরেজ সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকব এবং সাংবিধানিক পথে অগ্রসর হওয়ার প্রবলতম সমর্থক হব।’ সাভারকরের তরফে এমন অনেক ক্ষমা-প্রার্থনার নথি সরকারের কাছে রয়েছে। একটি দায়িত্বশীল সরকারের উচিত, সেই সব নথি পরীক্ষানিরীক্ষা করে সত্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং এ বিষয়ে কারও কোনও রকম সন্দেহ থাকলে, তা দূর করা। অন্য দিকে ভগৎ সিংহ ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকারকে লিখেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধবন্দি, আমাদের সঙ্গে সেই রকম ব্যবহার করাই উচিত... এবং ফাঁসি দেওয়ার বদলে আমাদের গুলি করে মারা হোক।’

১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে মহাত্মাকে গুলি করে মারার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতাদের গ্রেফতার করা হয় এবং দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। কয়েক দিন পরেই, ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে, এই কাজটি করা হয়েছে, কারণ ‘দেশ থেকে নির্মূল করা দরকার ঘৃণা ও হিংসা, যা আমাদের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারে।’ কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, ১৯৪৭-৪৮-এ হিন্দু ও মুসলমান উগ্রবাদীরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং বল্লভভাই পটেল দৃশ্যত নিশ্চিত ছিলেন যে গাঁধী হত্যার পেছনে আরএসএস-এর কোনও হাত নেই। আদালত সাভারকরকে গাঁধী হত্যার মামলায় সব রকম অভিযোগ থেকে রেহাই দিলেও পটেল আরএসএস-এর প্রতি অত্যন্ত কঠোর মনোভাব অনুসরণ করেই চলেছিলেন যত দিন না রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ জাতীয় পতাকাকে স্বীকার করে নেয়। পটেল আরএসএস নেতা গোলওয়ালকরের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারও আদায় করেছিলেন যে, এই দলের একটি লিখিত সংবিধান (নিয়মকানুন) থাকবে যাতে বলা থাকবে যে, দল সরাসরি রাজনীতি পরিহার করে ‘বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক কাজ’-এ আত্মনিবেদন করবে।

সেই অঙ্গীকার এখনও পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা আমাদের কাজ নয়, তবে পটেলকে যে ভাবে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর শিবিরে আত্মসাৎ করার তৎপরতা চলছে, তার তাৎপর্য বিচার করার জন্য এই তথ্যগুলি খুবই প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক চাপান-উতোরে বিশিষ্ট মানুষদের প্রতিষ্ঠা করার খেলাটা আগেও হয়েছে বটে, যদিও তা এখনকার মতো এত উগ্র ভাবে হয়নি। তবে ভুলে গেলে চলে না, সেলুলার জেলের একটি অংশ ভেঙে দিয়ে ব্রিটিশদের সমস্ত কুকীর্তি মুছে ফেলা হয় এবং সেই জায়গায় ১৯৬৩ সালে তৈরি হাসপাতালটি গোবিন্দবল্লভ পন্থের নামে নামাঙ্কিত হয়। জেলের শহিদদের কারও নামে কি ওই হাসপাতালের নাম রাখা যেত না?

সাভারকরকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে সম্পূর্ণ সত্যটা জানা দরকার, যাতে সাভারকর অনর্থক বিতর্ক থেকে মুক্তি পেয়ে, ইতিহাসে তাঁর যোগ্য স্থান পেতে পারেন। ইতিহাস তো আর কেবল হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ নয়, যেখানে রোজ ইতিহাস তৈরি হয়, ক্ষতিকারক মিথ্যের মোড়কে অর্ধসত্যকে তুলে ধরা হয়। মাঝে মাঝেই ইতিহাসের পর্যালোচনা করা ভাল, তা না হলে পরিবেশ বিষিয়ে উঠতে পারে। ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর নির্মাতারা তো নিরন্তর সেই বিষিয়ে তোলার কাজটা করেই চলেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Patriot Binayak Damodar Savarkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE