Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

টিউশনমুখী শিক্ষা: পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত

ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ। সকালে এক দফা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া। তার পরে স্কুল। স্কুল থেকেই ফিরে ফের কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের ক্লাসে। সপ্তাহে সাত দিনই কার্যত এক রুটিন ছেলেমেয়েদের। লিখছেন আশীষ দালাল।ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ। সকালে এক দফা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া। তার পরে স্কুল। স্কুল থেকেই ফিরে ফের কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের ক্লাসে। সপ্তাহে সাত দিনই কার্যত এক রুটিন ছেলেমেয়েদের। লিখছেন আশীষ দালাল।

পঠন-পাঠন: রামপুরহাটের একটি স্কুল চত্বরে ছাত্রীরা। ফাইল চিত্র

পঠন-পাঠন: রামপুরহাটের একটি স্কুল চত্বরে ছাত্রীরা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৬
Share: Save:

আমেরিকার বিখ্যাত প্রয়োগবাদী দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী তথা শিক্ষা সংস্কারক জন ডিউই বলেছেন, ‘বিদ্যালয় হল সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ’। যে সমাজ হবে পবিত্র, সরলীকৃত, ক্রমান্বিত, সুষম, অনুপ্রেরণায় জীবন্ত সক্ষম। সমাজের খারাপ নয়, যা কিছু ভাল সেগুলিই স্কুলের পরিবেশে পরিবেশিত হওয়া উচিত।

বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সুফল এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপে আসেনি। প্রাচীন কালে শিক্ষার্থীরা নিজের ঘর ছেড়ে গুরুগৃহে থেকে, গুরুর পরিবারের এক জন হয়ে বিদ্যাচর্চা করত। গুরুর আশ্রমই ছিল ছাত্রদের বিদ্যালয়। সেখানে ছাত্রসংখ্যা কম থাকার জন্য প্রত্যেক ছাত্রের প্রতি গুরুর বিশেষ নজর থাকত। গুরু ছিলেন জ্ঞান, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি।

শিক্ষকগণের প্রধান ও প্রাথমিক কর্তব্য স্কুলে শিক্ষাদান করা। শিক্ষা একটা মহান ব্রত। শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের মধ্যে অনেক সময় মতানৈক্য থাকলেও শিক্ষার লক্ষ্য তো একই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সে সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। স্কুলে নির্দিষ্ট সময়ে পাঠদান সম্পূর্ণ করলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষক স্কুলে তাঁর ছাত্রকে গতানুগতিক শিক্ষাদানের পরও তার সম্পর্কে অতিরিক্ত ‘খোঁজখবর’ রাখতেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অভিভাবক, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এক সুন্দর মেলবন্ধন দরকার। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এখন শিক্ষা অনেকটাই যান্ত্রিক। স্কুলগুলির বড় অংশে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক কম। স্বাভাবিক ভাবেই এক জন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাসের সব ছাত্রের ব্যক্তিগত ক্ষমতা অনুধাবন করে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। ফলত ছাত্রছাত্রীরা বিকল্প হিসাবে প্রাইভেট টিউশনের দিকে ঝুঁকছে।

প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সবাই শামিল। অভিভাবকেরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভাল রেজাল্টের জন্য শুধু স্কুলের উপরেই ভরসা রাখতে পারছেন না। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার নামে দৌড় দিচ্ছেন প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারের দিকে। এই করে করে টিউশনটা এখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে টিউশন-ব্যবসাও চলছে রমরমিয়ে। অনেক মাধ্যমিক পড়ুয়ার ৫-৬ জন গৃহশিক্ষক আছেন। ফি-বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক চ্যানেলে প্রথম থেকে দশম স্থানাধিকারী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানেও তাদের বলতে দেখা যায়, প্রায় সকল বিষয়ে একাধিক গৃহশিক্ষক ছিলেন।

এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা কী? না, স্কুলের বাইরের পড়া শেখাবেন গৃহশিক্ষক। ছাত্রকে ঘষেমেজে তৈরি করবেন নম্বর পাওয়ার ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’র জন্য, যাকে আমরা বলি পরীক্ষা। চারপাশে দেখতে পাই, ছোটছোট ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ। সকালে এক দফা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া। তার পরে স্কুল। স্কুল থেকেই ফিরে ফের কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের ক্লাসে। সপ্তাহে কার্যত সাত দিনই এক রুটিন। হাঁফ ধরার সময়ও পায় না ছোট ছো ছেলেমেয়েরা!

এই ছবিটা শুধু আমাদের রাজ্যের, বলা যায় গোটা দেশেরই। প্রাইভেট টিউশনি এমন ভাবে জাঁকিয়ে বসেছে, যে তার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার কোনও পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ প্রাইভেট টিউশনির বিপক্ষে শিক্ষাবিদেরা নানা যুক্তি দেন। তাঁদের মতে, টিউশনি ব্যাপারটাই ক্ষতিকর। কেন তাঁরা এ কথা বলেন? তাঁদের মতে, এতে অভিভাবকদের অর্থের অপচয় হয়।

দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত সময় নষ্ট হয় পড়ুয়ার, যে সময়টা (কোয়ালিটি টাইম) সে নিজে পড়া তৈরির পিছনে দিলে তার উপকার হবে। তৃতীয়ত, প্রাইভেটে পড়ার ফলে স্কুলের পড়াশোনার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ আগ্রহী হারাচ্ছে। স্কুল-শিক্ষা ‘প্রাণহীন’ হয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, স্রেফ বোর্ডের পরীক্ষায় বসতে স্কুলের নাম থাকাটা জরুরি বলে।

এর বিপক্ষেও যুক্তি রয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের একাংশের বক্তব্য, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যে সম্পর্ত অতীতে ছিল, সেটাও দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু। এই অভিভাবকেরা সন্তানের পড়াশোনার জন্য কাঠগড়ায় তোলেন স্কুল তথা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। তাঁদের যুক্তি, স্কুলে ঠিকমতো পড়ানো হয় না বলেই তাঁরা ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউশনি দিচ্ছেন। তা ছাড়া, কোনও শিক্ষার্থীকে আরও ‘ভাল ভাবে তৈরি করা’র জন্য প্রাইভেট টিউশনি দিলে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই বলেও ওই অংশের যুক্তি।

এর পাল্টা হিসাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের একাংশের বক্তব্য, পড়ুয়ারাই অমনোযোগী। তাই লেখাপড়াটা হচ্ছে না। যে সব শিক্ষার্থী একাধিক বিষয়ে প্রাইভেট টিউশন পড়ছে, তাদের একাংশ স্কুলে শিক্ষকদের পাঠ নিতে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। ভাবখানা এমন যে , এ সব তো আমার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে! এই প্রবণতা সংক্রামক। এক জনের থেকে অন্য শিক্ষার্থী যে কিনা প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার কথা চিন্তা করেনি, সে-ও মনে মনে ভাবতে শুরু করে প্রাইভেটে পড়লেই তো ভাল দেখছি!

এই চাপানউতোরের মাঝে যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে ‘শিক্ষা’। ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন করানোর ইচ্ছে—দুই মিলে বিদ্যালয়ের সাবেকি সম্পর্কে চিড় ধরেছে।

শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি এবং সরকারি অনুদান প্রাপ্ত স্কুলগুলির শিক্ষকেরা অর্থের বিনিময়ে টিউশন করতে পারেন না। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশ থাকলেও অভিভাবক-শিক্ষক-ছাত্র সকলকেই এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। এখন যদিও পশ্চিমবঙ্গ প্রাইভেট টিউটর অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা প্রাইভেট টিউশন করেন। এমনকি প্রজেক্ট ও প্র্যাকটিক্যালে ভাল নম্বরের জন্য সেই স্কুলের শিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রীরা টিউশনের জন্য ভিড় করছে। যদি কিছু সংখ্যক শিক্ষক এ রকম করেন, তা হলে অবশ্যই তা নিন্দনীয়।

তবে আমার মনে হয়, এটা ব্যতিক্রম। কয়েক জনের জন্য সমস্ত শিক্ষককে দায়ী করা যায় না। শিক্ষকেরা যাতে ক্লাস ফাঁকি দিতে না পারেন, সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা ক্লাস মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। এবং শিক্ষকগণ তাঁদের ব্রত পালনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে আমাদেরই আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সততার পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে হবে। পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা দরকার। যেখানে শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো প্রাইভেট টিউশনের জন্য দৌড়বে না। সে তার সমস্ত চাহিদা শিক্ষাকেন্দ্রেই পাবে।

(লেখক নিশ্চিন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Debate private Tuition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE