Advertisement
১১ মে ২০২৪
Coronavirus

করোনা টিকার সোনার কাঠি

টিকা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া জটিল। ল্যাবরেটরিতে কোনও সম্ভাবনাপূর্ণ কেমিক্যালের সন্ধান পেলেই তা দেওয়া যায় না রোগীকে।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

নব্বইয়ের দশকের এডস মহামারির পরে কোনও অসুখের প্রতিষেধক বার করাকে এতখানি গুরুত্ব দেয়নি গোটা পৃথিবী। আজ করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির দৌড়ে শামিল দেশ-বিদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা, সরকারি এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

টিকা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া জটিল। ল্যাবরেটরিতে কোনও সম্ভাবনাপূর্ণ কেমিক্যালের সন্ধান পেলেই তা দেওয়া যায় না রোগীকে। নিয়ম-কানুন মেনে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সফল হলে তবেই বানানো সম্ভব প্রতিষেধক। প্রথমে মনুষ্যেতর প্রাণীর উপর পরীক্ষা। তার পর মানুষের উপর, যাকে বলে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় সবাই এত দিনে জেনে গিয়েছেন যে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চারটে পর্যায়। ওষুধ তৈরিতে অবশ্য দরকার প্রথম তিনটে পর্যায়ের পরীক্ষা। প্রথম পর্যায়ে সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকদের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয় ওষুধটির কোনও গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে কি না। দ্বিতীয় পর্যায় থেকে প্রয়োজন রোগীর। দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার বিষয়বস্তু ওষুধের কার্যকারিতা এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দুইই; তৃতীয় পর্যায়ে শুধুমাত্র কার্যকারিতা। প্রতি পর্যায়ে রয়েছে অজস্র খুঁটিনাটি, অসুখের প্রকৃতি এবং ফলাফলের সম্ভাব্য নির্ভুলতার উপর নির্ভর করে নমুনা-সংখ্যার হিসেব, এবং রাশিবিজ্ঞানের মানদণ্ডে ওষুধের কার্যকারিতার বিশ্লেষণ। তিনটি পর্যায়ের শেষে যদি দেখা যায় ওষুধটি কার্যকরী এবং তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক নয়, তা হলে সমস্ত তথ্যাদি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দেশের চিকিৎসা সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। ওষুধটিকে নিরাপদ এবং কার্যকরী মনে করলে সেই সংস্থা অনুমতি দেয় ওষুধটির বাণিজ্যিকীকরণের।

পুরো প্রক্রিয়াটা কিন্তু দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। অতীতে অনেক অসুখেরই প্রতিষেধক আবিষ্কারে লেগে গিয়েছে দশ-বিশ বছর বা আরও বেশি। করোনার ক্ষেত্রে অবশ্য নানা ভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় কমানোর চেষ্টা চলেছে জরুরি ভিত্তিতে। তবু অভিজ্ঞতা বলে, প্রতিষেধক পেতে অন্তত এক থেকে দেড় বছর লাগবেই। এমনটাই বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বলছেন স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা। আসলে বিশ্ব জুড়ে করোনা ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলির বেশির ভাগই কিন্তু প্রথম পর্যায়ে আটকে আছে এখনও। সামান্য কিছু দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা হয়তো চলছে। শেষ পর্যন্ত এগুলোর ফলাফল কী হবে, তা কিন্তু একেবারেই অজানা।

আর একটা কথা। গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে মানেই যে প্রতিষেধক টিকাও নিশ্চিত, তা কিন্তু নয়। যে কোনও পর্যায়েই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এ যাবৎ কালের হিসেব বলছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তিনটি পর্যায়ে সাফল্যের হার ১৪ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ গড়ে সাতটির মধ্যে ছ’টি ট্রায়ালই ব্যর্থ হয়। ভাইরাস-ঘটিত অনেক অসুখের— যেমন এডস-এর— কোনও প্রতিষেধক তৈরি করা যায়নি বহু চেষ্টা করেও। প্রায় দু’দশক পরেও ‘সার্স’-এর বা দশক ঘুরতে চললেও ‘মার্স’-এরও কোনও টিকা নেই এখনও। তাই করোনার টিকা যে চট করে তৈরি হবেই, সেই নিশ্চয়তা নেই।

অবশ্য পৃথিবী জুড়ে কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়েছে শতাধিক সংস্থা। টিকা আবিষ্কার করতে পারা মানেই বিপুল ব্যবসায়িক সম্ভাবনা। এত বড় কর্মকাণ্ডের কল্যাণে আজ না হোক কাল টিকা আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা ভালই। ধরা যাক, টিকা পাওয়া গেল। তার পর? পৃথিবীর ৭৮০ কোটি লোকের জন্য টিকার কয়েকশো কোটি ডোজ় কে বানাবে? কতটা সময় লাগবে? ভারতের ১৩৫ কোটি মানুষকে টিকার রক্ষাকবচ পরিয়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পাঠাতে কত সময় লাগবে? কতটা সময় লেগেছিল সবাইকে পোলিয়োর টিকা দিতে?

সেই টিকার দাম কত হবে? কোটি কোটি ডলার খরচ করে টিকা বানাবার প্রকল্পে নেমেছে যে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো, তারা দান-খয়রাতি করতে নামেনি। কত শতাংশ মানুষ বইতে পারবে সেই টিকার খরচ? আম আদমি কী করে জোগাবে ভ্যাকসিনের দাম, সরকার কী ভাবে সার্বিক টিকাকরণের ব্যবস্থা করবে, জানা নেই কিছুই।

তবু ধরা যাক, কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। দেশভেদে নিজেদের স্টাইলে। কিন্তু, টিকা নামক সেই সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ঠিক কত ক্ষণ স্বাভাবিক থাকতে পারবে করোনার কালবেলায় স্থবির হয়ে যাওয়া সভ্যতা? টিকার কার্যকারিতার স্থায়িত্ব কতটা? এক বার টিকা দিলে, অর্থাৎ অ্যান্টিবডি শরীরে এলে, কত দিন নিশ্চিন্ত থাকা যাবে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে? টিকার প্রতীক্ষায় যাঁরা প্রহর গুনছেন, এর স্পষ্ট উত্তর জানা নেই তাঁদের। ভাইরাস-ঘটিত অসুখ-ভেদে শরীরে অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব বিভিন্ন রকমের। পক্সের মতো অসুখ এক বার হলে, সচরাচর আর হয় না। অ্যান্টিবডি শরীরে থেকে যায় অনেক দিন। সাধারণ সর্দিকাশি বার বার হয়। করোনাভাইরাসের চরিত্র এখনও অজানার অন্ধকারে।

জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ‘নেচার মেডিসিন’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে কিন্তু আশঙ্কার কালো মেঘ। ছোট মাপের এক স্টাডিতে দেখা গিয়েছে, করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি নাকি শরীরে কার্যকর থাকতে পারে মাত্র ২-৬ মাস। সে কিন্তু এক ডিসটোপিয়ান ভবিষ্যতের ইঙ্গিত! তা হলে তো তিন মাস পর পর আমাদের নিয়ম করে টিকা নিয়ে যেতে হবে আগামী দিনগুলিতে। অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত দিক থেকে সেটা আদৌ সম্ভব? টিকা নিয়ে এই রাজসূয় যজ্ঞের সারবত্তাই তো তা হলে প্রশ্নের মুখে পড়বে। এ বিষয়ে আরও বড় মাপের বিস্তৃত গবেষণা হবে নিশ্চয়ই আগামী দিনগুলিতে। আশা করা যাক, পরিস্থিতি অতটাও খারাপ হবে না। আপাতত সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, সাবান, স্যানিটাইজ়ার, বা ফেসমাস্ক থেকে এই মুখোশে-ঢাকা সভ্যতার মুক্তি পাওয়া কঠিন।

রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Vaccine WHO Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE