Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Health

শশী ডাক্তারের কথা মনে পড়ে

জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সক্রিয় না হলে, চিকিৎসা পরিকাঠামো কাজ না করলে চিকিৎসকও অসহায়।

শ্যামল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

পাকা চুলের উপরে শোলার হ্যাট, গলায় দোনলা স্টেথো, সাইকেল চেপে রোগী দেখতে চলেছেন নরেন ডাক্তার। পাড়ায় ডায়রিয়া হচ্ছে, ডাকলেই ডাক্তারবাবু হাজির। রোগী দেখছেন, নুন-চিনির জল বানাতে শেখাচ্ছেন, নিজে সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে সবাইকে বলছেন, রোগীর সংস্পর্শে এলেই হাত ধুয়ে নিতে। পানীয় জল ফুটিয়ে খেতে।

লকডাউনের দিনগুলোতে ছেলেবেলায় দেখা এই ডাক্তারবাবুদের মনে পড়ছে খুব। রোগীর নাড়ি-নক্ষত্র জানতেন, বিপদে পাশে থাকতেন। সমাজ বিনিময়ে ওঁদের ভালোবাসত।

সেই ডাক্তারবাবুরা হারিয়ে গেছেন সেই কবে! লকডাউনের দিনগুলোতে যানবাহনের অভাবে বহু মানুষ সরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে কেন পেলেন না স্থানীয় ডাক্তারবাবুদের চিকিৎসা, কেনই বা ডাক্তার হয়েও এক শ্রেণির চিকিৎসক অস্বীকার করলেন অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করতে? প্রশ্নটা কুরে কুরে খায়। এক দিকে শহর-গ্রামে, ল্যাবে-হাসপাতালে, অপারেশন থিয়েটারে প্রাণ বাজি রেখে কিছু ডাক্তার, ডাক্তার-প্রশাসক লড়ে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঁধে কাঁধ রেখে। অন্য দিকে ডাক্তারদের একাংশ করোনাতঙ্কে রোগীর ফোন পর্যন্ত ধরছেন না। বহু প্রাইভেট ডাক্তার চেম্বার বন্ধ করে রেখেছেন। সরকারি হাসপাতালে এক দিনও মুখ দেখাচ্ছেন না কিছু চিকিৎসক। অনেক রোগীকে কয়েক হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে গ্রাম, মফস্সল থেকে ছুটে আসতে হচ্ছে কলকাতায়। এমন সব খবর আসছে একের পর এক। আর বড় বেদনার মতো গভীর যন্ত্রণা বারবার বেজে উঠছে মনে।

করোনা-আতঙ্কে চিকিৎসকরাও যে বিপন্ন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজের একটা অংশ যে ভাবে ঘরছাড়া করেছেন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের, তা নিশ্চয়ই চিকিৎসকদের একাংশকে আতঙ্কিত করেছে। চিকিৎসকদের অপবাদ দিতে অতি-আগ্রহী সমাজমাধ্যম তো আছেই, বেসরকারি ডাক্তারের চেম্বারে একজনও রোগী কোভিড-আক্রান্ত হলে ডাক্তারকে ‘অর্থপিশাচ’ তকমা দিতে দেরি করত না! ইট-পাটকেল ছুটে আসত ডাক্তারের বাড়ির দিকে। জুনিয়র ডাক্তার-পেটানো বাঙালি, ' ভিজিট' কম এমন চিকিৎসককে তাচ্ছিল্য করা বাঙালি, ' প্লেন এমবিবিএস' বলে নাক সিঁটকানো বাঙালি, কর্তব্যরত ডাক্তারদের পিটিয়ে, ডাক্তারের গায়ে বিষ্ঠা মাখিয়ে আত্মশ্লাঘায়-ভোগা বাঙালি আমরা।

অথচ করোনার সঙ্গে অনেক দিন ঘর করতে হবে আমাদের। করোনাই শেষ নয়, লাইনে আছে আরও অনেক সংক্রামক ভাইরাস। ফিরে ফিরে আসবে মহামারি, অতিমারি। সে সব দিনে কে জোগাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা, কী ভাবেই বা পরিত্রাণ মিলবে মানবতার।

সব মানুষ যেমন ডাক্তারদের নিগ্রহে যুক্ত থাকেন না, তেমনই অধিকাংশ চিকিৎসকও কর্তব্য এড়াতে চান, এমন নয়। বরং প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও চান মানুষকে রোগমুক্ত করতে, সুস্থতার আশ্বাস জোগাতে। কর্মস্থলের দায়বদ্ধতা পালন করার পরেও বহু চিকিৎসক যাচ্ছেন সুন্দরবনের নানা জায়গায়, আমপানে বিধ্বস্ত এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে। যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে ডাক্তাররা যেমন করে থাকেন। কোভিড এড়াতে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা যখন ইস্তফা দিচ্ছেন, তখন কিছু বেসরকারি হাসপাতাল স্বেচ্ছায় কোভিড রোগীর জন্য দরজা খুলে দিচ্ছে। আবার এ-ও ঠিক যে এই বিপন্নতার সময়েও বাণিজ্যিক স্বার্থকে সামনে রাখতে দ্বিধা করছে না কিছু হাসপাতাল, কিছু ডাক্তার। লকডাউনের আগে যে হাড়ের অস্ত্রোপচার করতে লাগত আট হাজার টাকা, কেন তার জন্য এখন ষোল হাজার টাকা নেওয়া হবে, মেডিক্যাল পেশার মানুষদের কাছেও তার ব্যাখ্যা সহজ নয়। মানুষকে বোঝাব কী করে।

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ের গায়েও তার আঁচ লাগে। অর্থনীতি ভেঙে পড়লে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বিপন্ন হবে। চিকিৎসকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিটা কেবল রোজগারের অঙ্কে নয়। যদিও সেটাও খুব কম নয়, সত্তর শতাংশের বেশি ডাক্তার এ দেশে শ্রেণি অবস্থানে মধ্যবিত্ত, বড়জোর উচ্চ মধ্যবিত্ত।

ঝুঁকি অন্যত্র। স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। দরিদ্রতম মানুষও অসুখ হলে সুচিকিৎসা প্রত্যাশা করেন। অথচ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সক্রিয় না হলে, চিকিৎসা পরিকাঠামো কাজ না করলে চিকিৎসকও অসহায়। ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থাকলেও তিনি রোগীর প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারবেন না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিনিয়োগ না করলে চিকিৎসক-রোগী দুই পক্ষই বিপন্ন হবে।

তবে ভারতে দুর্বল পরিকাঠামো, খুঁড়িয়ে-চলা হাসপাতালেই কাজ করে আসছেন ডাক্তাররা। যেখানে ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ব্যক্তিই তাঁর সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অতিমারির দিনগুলোতে সেই ছেলেবেলায় দেখা সাইকেল-চাপা ডাক্তারবাবুদের কথা মনে পড়ে যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার শশী ডাক্তারের কথা মনে পড়ে। গ্রামের মানুষের সব ক্ষুদ্রতা, অজ্ঞানতা বুঝেও যে সরে যেতে পারেনি। গ্রামজীবনের অংশীদার হয়ে রয়ে গিয়েছিল।

স্ত্রীরোগ বিভাগ, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE