Advertisement
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাসভের রাশ

মানুষ সমাজ স্থাপন করিয়াছে এবং তাহার সুষ্ঠু পরিচালনার নিমিত্ত আইন নামক ব্যাপার প্রণয়ন করিয়াছে। মুশকিল হইল, অন্য কোনও জীবের সম্মতি এই সকল বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে লওয়া হয় নাই।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩৬
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশে আটটি গাধার চার দিন হাজতবাস হইল। জেল সীমানার বাহিরে লক্ষাধিক টাকায় ক্রীত কিছু গাছ রোপণ করা হইয়াছিল, গাধাগুলি তাহা খাইয়া ফেলিয়াছে। মানুষ সমাজ স্থাপন করিয়াছে এবং তাহার সুষ্ঠু পরিচালনার নিমিত্ত আইন নামক ব্যাপার প্রণয়ন করিয়াছে। মুশকিল হইল, অন্য কোনও জীবের সম্মতি এই সকল বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে লওয়া হয় নাই। তাহা হইলে সেই আইন মানিতে অন্য প্রাণী আদৌ বাধ্য থাকিবে কেন? আইন ঔচিত্যের ধারণার উপর নির্ভরশীল, মনুষ্যেতর প্রাণীদের ঔচিত্যের ধারণা সম্ভবত নাই। আর থাকিলেও তাহা মানুষের ধারণার সহিত না মিলিতেই পারে। বাঘের মতে হয়তো দুর্বল প্রাণীদের ধরিয়া খাওয়া উচিত। মানুষের মতে, দুর্বলকে যে-সবল হত্যা করে সে অপরাধী। কিন্তু এই মতের উপর নির্ভর করিয়া বাঘকে ধারাবাহিক হত্যাকারী (সিরিয়াল কিলার) বলিয়া ফাঁসিতে চড়াইলে তাহা উদ্ভট কার্য হইবে। তেমনই, মানুষের মতে, অনেক টাকা দিয়া যাহা ক্রয় করা হয়, তাহা বিনষ্ট করিলে হাজতবাস হওয়া উচিত। গাধার মতে হয়তো, প্রকৃতি যাহা গাছপালার রূপে সাজাইয়া রাখিয়াছেন, তাহা খাদ্য। তাহা খাইলে তাহাকে বিনষ্ট করা বলে না, আর ক্ষুধা পাইলে খাইবার অধিকার সকল প্রাণীর রহিয়াছে। গাধাকে টাকা অথবা সম্পত্তির ধারণা শিখাইতে গিয়া লাভ নাই। সে কিছুতেই বুঝিবে না সুখাদ্য সম্মুখে দেখিলেও কেন তাহা খাওয়া যাইবে না, কারণ তাহা নাকি ক্রয়কারীর সম্পত্তি। মানুষের এই এক আশ্চর্য প্রবণতা, সে মনে করে তাহার মূল্যবোধের বান্ডিলখানি সমগ্র মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইবার যোগ্য। সে যে অন্যতম প্রাণী, কখনওই একমাত্র প্রাণী নহে, ইহা তাহার মস্তিষ্কে ঢোকে না। সে যেহেতু সর্বাধিক শক্তিশালী প্রাণী, তাই সে প্রতিটি প্রাণীকে অধীনস্থ বলিয়া বিচার করে এবং তাহাদের প্রতি প্রকাণ্ড অত্যাচারকে প্রায় সর্বাংশে সংগত বলিয়া ধরে। তাহাদের উপর নিজের আইন চাপাইয়া দেওয়াকেও সে সার্বিক ন্যায়েরই অঙ্গ বলিয়া ধরিয়াছে।

আইন যদি সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধি ছাড়িয়া কেবল কয়েকটি অনুশাসনের আক্ষরিক আলোকে বাস্তবকে নিরীক্ষণ করিতে শুরু করে, তবে সে তাহার তাৎপর্য হারাইবে। চার্লস ডিকেন্সের ‘অলিভার টুইস্ট’ উপন্যাসে এক চরিত্র বলিয়াছিল, ‘...ল ইজ আ অ্যাস’। অর্থাৎ আইন যদি উদ্ভট ভাবনাকে সত্য ধরিয়া চলে তবে সে একটি গাধা। ‘অ্যাস’ শব্দটির পূর্বে ‘অ্যান’-এর পরিবর্তে ‘আ’ বসানোটি নিশ্চয় ডিকেন্সের নিপুণ কারসাজি। অবশ্য, আইনকে গাধা বলা হইয়াছিল আরও দুই শতক পূর্বের একটি নাটকে, হয়তো বা তাহার আগেও। কিন্তু গাধা-গ্রেফতারের পরে আর এই কথাকে তেমন নাটকীয় বলা চলিবে না। বস্তুত, আগেও কি বলা চলিত? ইউরোপে দ্বাদশ হইতে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি কিছু জন্তুর বিচার করা হইয়াছে, বহু ক্ষেত্রে তাহাদের মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হইয়াছে। ২০১৫-য় ভারতে এক পায়রা গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার হইয়াছিল। গত বৎসর মেক্সিকোতে এক গাধাকে গ্রেফতার করা হয়, মানুষকে দংশনের অপরাধে। কল্পবিজ্ঞান-লেখক স্তানিসোয়াভ লেম বারংবার বলিয়াছেন, মানুষ নিজেকে সর্বদা কেন্দ্রে রাখিয়া বিশ্বের সকল কিছুর বিচার করে, নিজের নীতিকে সর্বত্রসিদ্ধ বলিয়া ধরে, তাহার এই ঔদ্ধত্য তাহাকে মহা-মস্তানের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করিতেছে মাত্র। লেম-এর এক উপন্যাসে একটি গ্রহের সমুদ্র চেতন পদার্থ হইয়া বিরাজ করে। সেই সমুদ্র যখন তাহার উপর অসংখ্য-নিরীক্ষাকারী মানুষের স্মৃতি বা কল্পনা হইতে অবয়ব প্রস্তুত করিয়া সেইগুলিকে মানুষের নিকট প্রেরণ শুরু করে, মানুষ তাহাকে মহাশত্রু ঠাওরায়। কিন্তু ইহাই হয়তো সমুদ্রের যোগাযোগ-চেষ্টা, বা মানুষের উপর তাহার ফিরতি নিরীক্ষা। আর এক উপন্যাসে একটি গ্রহে কেবল ক্ষুদ্র যন্ত্রেরা থাকে এবং তাহারা সহসা-আগন্তুক মানুষের স্মৃতি শুষিয়া লয়। যন্ত্রগুলি মানুষকে চিনে না বুঝে না, স্রেফ আত্মরক্ষার্থে এই কাজ করে। তাহাদের নিকট মানুষের নীতি-সদৃশ ন্যায়মার্গ-গুচ্ছ আশা করাও অন্যায়, কারণ তাহারা তো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকারের সত্তার অধিকারী। কিন্তু ইহাদেরও তীব্র শত্রু মনে করা হয়। এক মহাকাশচারী বলে, তাহা হইলে ঝড়ে মানুষ মরিলে ঝড়ের বিরুদ্ধেও অভিযান করিতে হয়, কিন্তু কেহ তাহা মানে না। গাধাকে গ্রেফতার হাস্যকর ঘটনা, কিন্তু মানুষের এই নিজ শর্তে প্রতিটি জীবকে বাঁধিবার ও ছড়ি ঘুরাইবার প্রবণতাটি এইখানেও প্রতিফলিত। ইহার মধ্যে যে বুদ্ধিহীন আত্মপ্রশ্রয় রহিয়াছে, আশা করা যাক তাহা লইয়া কেহ তৃতীয় সুর ষষ্ঠ সুর ভাঁজিতেছে না।

যৎকিঞ্চিৎ

বিরাট কোহালির সাফল্য এখন কাটা-রেকর্ডের মতো, এক গতে আটকে গেছে। রোজ রোজ সফল। লোকে এর পর বোর হয়ে যাবে, হাততালি দেবে না। যেমন রোজ ক্রিকেট দেখে লোকের হাই উঠছে এবং সে অন্য খেলায় উঁকি দিচ্ছে, এর পর সবাই জানতে চাইবে: ম্যাচে অন্যরা কী করল বল, বিরাট তো সেঞ্চুরি করবেই। আর এক-আধ বার কোহালি নব্বইয়ে আউট হলে, টিটকিরির বন্যা! ইমেজ-ম্যানেজারের উচিত, বিরাটকে বলা, কয়েক বার বিচ্ছিরি ব্যর্থ হোন, বৈচিত্র শিখুন!

অন্য বিষয়গুলি:

Uttar Pradesh Donkey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy