Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পাঞ্চলে ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে বাংলাভাষা

দোকানের সাইনবোর্ডে থেকে বিজ্ঞাপন— বাংলার ব্যবহার কার্যত দেখাই যায় না। রাস্তাঘাটেও বাংলা কম শোনা যায়। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার সবার আছে। কিন্তু, শিল্পাঞ্চলের বাঙালিরা কী করছেন? লিখছেন অরুণাভ সেনগুপ্তবিশেষজ্ঞেরা দেখিয়েছেন, ভাষামৃত্যুর অন্যতম কারণ, প্রধান, শক্তিশালী ভাষার প্রভাবে অপ্রধান ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রধান ভাষা ব্যবহারের দিকে ঝোঁকা। যাকে ভাষাতত্ত্বে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’ বা ‘ভাষা বদল’ বলে। অবলুপ্ত হওয়ার আগে ভাষাকে গ্রাস করে বিপন্নতা বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ এনডেঞ্জারমেন্ট’।

সাইনবোর্ডেও বিরল বাংলা। নিয়ামতপুর। ছবি: পাপন চৌধুরী

সাইনবোর্ডেও বিরল বাংলা। নিয়ামতপুর। ছবি: পাপন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:০৪
Share: Save:

ভাষার মৃত্যু বা অবলুপ্তি বাস্তব ঘটনা। ভাষার মৃত্যু তখনই ঘটে, যখন ভাষা পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় না। ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টাল দেখিয়েছেন, সারা বিশ্বে প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটে। এখন সারা বিশ্বে মোটামুটি ৬,৭০০-র মতো ভাষা আছে। এ ভাবে চললে ১০০ বছর পরে ভাষার সংখ্যা কমে দাঁড়াবে তিন হাজারে। এ কথা উঠে আসছে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বাংলা ভাষার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে। শিল্পাঞ্চলে বাংলা ভাষা আজ বিপন্ন। অনেকে হয়তো স্বীকার করবেন না। তবে বাংলা যে তার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটি খুইয়ে ফেলছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

বিশেষজ্ঞেরা দেখিয়েছেন, ভাষামৃত্যুর অন্যতম কারণ, প্রধান, শক্তিশালী ভাষার প্রভাবে অপ্রধান ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রধান ভাষা ব্যবহারের দিকে ঝোঁকা। যাকে ভাষাতত্ত্বে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’ বা ‘ভাষা বদল’ বলে। অবলুপ্ত হওয়ার আগে ভাষাকে গ্রাস করে বিপন্নতা বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ এনডেঞ্জারমেন্ট’। সম্ভাব্য বিপন্নতা, বিপন্নতা, গভীর বিপন্নতা ও মুমূর্ষু অবস্থা — এই চারটি পর্যায়ে এটি ঘটে। শিল্পাঞ্চলের বাংলাভাষা নিয়ে এই আশঙ্কায় ভুগছি।

দোকানের সাইনবোর্ডে থেকে বিজ্ঞাপন— বাংলার ব্যবহার কার্যত দেখাই যায় না। রাস্তাঘাটেও বাংলা কম শোনা যায়। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার সবার আছে। কিন্তু শিল্পাঞ্চলের বাঙালিরা কী করছেন? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি ঘটনার কথা বলি। শিল্পাঞ্চলে অচেনা কোনও দোকান বা অফিসে গেলে সংলাপ শুরু হয় এবং এগিয়েও যায়, বাংলায় নয়, হিন্দি অথবা ইংরেজিতে। মধ্যবিত্ত বাঙালি গৃহবধূ ফুটপাতের দোকানে দরদাম করেন বাংলায় নয়, অপটু হিন্দি লব্‌জে। শপিং মলে বাঙালি ক্রেতা যে ভাষায় কথা শুরু করেন, তা তাঁর মাতৃভাষা নয়। কিন্তু দু’জনেই বাঙালি। দুর্গাপুরের একটি সম্ভ্রান্ত খাদ্যবিপণিতে খেতে বসে দেখি, পাশের টেবিলের বাঙালি ভদ্রলোক খাবার বরাত নিতে আসা টাই-শোভিত ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা চালালেন আদ্যন্ত ইংরেজিতে। পরে বুঝলাম তিনিও বাঙালিই। হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে একটা ছবি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একটা ভাষার পিছিয়ে পড়ার ছবি।

আবার অভিজ্ঞতা বলে সিকি শতাব্দী আগেও কিন্তু শিল্পাঞ্চলে বাংলা ভাষার অবস্থানটি এমন ছিল না। শিল্পাঞ্চল হিসেবে এই অঞ্চলের বিকাশ শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কয়লাখনির পত্তনের পরে। রানিগঞ্জ স্টেশন চালু হল ১৮৫৫ সালে। আর আসানসোল স্টেশন ১৮৬৩ সালে। ক্রমে জেগে উঠল শিল্পাঞ্চল। তৈরি হল বিভিন্ন কলকারখানা এবং অনুসারী শিল্প। শ্রমিক হিসেবে ভিন্ প্রদেশের মানুষের আসা শুরু কয়লাখনির স্থাপন থেকেই। এই শিল্পের সূত্রেই বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ থিতু হলেন শিল্পাঞ্চলে। শিল্পের সেই স্বর্ণযুগে বাংলা ভাষার অবস্থান ছিল গরিমাময়। অবাঙালি সহবাসীদের কাছে, বাংলা কথ্যভাষার শিক্ষাটি ছিল উদ্দীপনাময়। কিন্তু ক্রমে এই অঞ্চলের শিল্পের মানচিত্রটি বিবর্ণ হয়ে গেল।

একটি ভাষার গুরুত্ব, স্থায়িত্ব বা বহমানতা শুধু ভাষার নান্দনিক ঐশ্বর্যের উপরে নির্ভর করে না। নির্ভর করে তার ব্যবহারিক প্রয়োজনের উপরেও। নির্ভর করে সেই ভাষা কর্মক্ষেত্রে, বাণিজ্যে কতটা সহায়ক হতে পারে— তার উপরেও। এই ব্যাপারেই শিল্পাঞ্চলের চালক হিসেবে বাংলা ভাষার আসনটি যেন আলগা হয়ে গেল। সম্প্রীতির বন্ধনটি অটুট থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিল্পাঞ্চলের ভিন্নভাষী নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাভাষা শেখার বা বলার প্রয়োজন কমে গেল। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, বাংলাভাষীরাই তাঁদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না। বাঙালিদের এমন করার কারণ কী? অর্থনৈতিক, বাণিজ্যগত কারণ তো বটেই, বিশ্বায়নের আগ্রাসী ভূমিকা এই শিল্পাঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিগত অবস্থান অনেকটাই পাল্টে দিল। টিভির মাধ্যমে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার সিরিয়াল, সিনেমা, বিজ্ঞাপন বাংলা ভাষাকে কোণঠাসা করেছে। এই পথেই বিয়েতে নাচ, মেহেন্দি, ধনতেরাস, হনুমান বা গণেশপুজোর বাংলার সংস্কৃতিতে জায়গা পেল। আর বিশ্বায়নের সঙ্গেই এল পণ্যায়ন। পণ্যায়নের মূল লক্ষ্যই হল ভাষা বা সংস্কৃতিকে একই ছাঁচে ঢেলে ফেলা, তার বৈচিত্র নষ্ট করা। যাতে পণ্যের চলাচল সুগম হয়।

অন্য দিকে, চাকরির সহায়ক ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব যত বাড়তে থাকল, ততই বাঙালি ভুগতে শুরু করল হীনমন্যতায়। ভাষার মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন ভাষাবিদ ন্যান্সি ডোরিয়ান। কোণঠাসা ভাষার মানুষদের নিজের ভাষার প্রতি এই তাচ্ছিল্যকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘ইডিওলজি অব কনটেম্পট’। এর ছাপ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি পড়ল সীমান্ত সংলগ্ন শিল্পাঞ্চলে। চাহিদা বাড়ল ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ের। এমনকি, নিম্নবিত্ত বাঙালির কাছেও। এখন তো শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু বাংলামাধ্যমের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে ধুঁকছে। তাই কিছু বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ে বাংলার পাশাপাশি, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। সেই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন বার্নপুরের শান্তিনগর বিদ্যালয় (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, আনন্দবাজার পত্রিকা)।

তবে শিল্পাঞ্চলে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে চিত্রটি পুরোটাই হতাশাব্যঞ্জক নয়। শিল্পাঞ্চলের অনেক সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা করার সংস্থা বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতার কাজ করে চলেছে। সম্প্রতি আসানসোলে বাংলা মাধ্যমের ঐতিহ্যশালী ইস্টার্ন রেলওয়ে স্কুলে বাংলামাধ্যম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু, বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিবাদের ফলে ইংরেজির সঙ্গেও বাংলামাধ্যমও বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এর পাশাপাশি, পরবর্তী প্রজন্মে মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসাটি সঞ্চারিত করা দরকার। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও বাংলা শেখার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন প্রজন্ম ‘হ্যারি পটার’-এর পাশাপাশি, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘জ্যাক অ্যান্ড জিল...’ এর পাশাপাশি, ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি...’ ছড়াটিও শিখুক।

আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bengali language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE