Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Water Body

ঠিক যেন রাজনীতির দুয়োরানি

১৯৭১ সালে রামসার সম্মেলনে আন্তঃসরকার পরিবেশ চুক্তি করে ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি চিহ্নিতকরণের বন্দোবস্ত হয়।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২১ ০৬:৩৩
Share: Save:

গত মাসে প্রায় নীরবেই পেরিয়ে গেল বিশ্ব জলাভূমি দিবস। পরিবেশকর্মী, বিজ্ঞানীরা কেউ গলা ফাটিয়েছেন, কিন্তু রাজনীতির জোর না থাকলে কে কার কথা শোনে! তবু পরিবেশ, বিশেষত জলাভূমির অবক্ষয়ে আমরা এমন খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি যে, এই সব গলার স্বর বিবর্ধিত করতে না পারলে অস্তিত্ব সঙ্কট।

১৯৭১ সালে রামসার সম্মেলনে আন্তঃসরকার পরিবেশ চুক্তি করে ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি চিহ্নিতকরণের বন্দোবস্ত হয়। তেমন জলাভূমিকেই বলে ‘রামসার সাইট’। ইদানীং ভারতে পরিবেশগত ভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রামসারের মর্যাদা পাচ্ছে, কিন্তু ধুঁকছে জীববৈচিত্রে ভরপুর অঞ্চল, পুরনো রামসারও। এর কারণও কিছু অনুমেয়। যেমন, সম্প্রতি রামসার হওয়া মহারাষ্ট্রের অতি-ক্ষারীয় জ্বালামুখ হ্রদ লোনার লেকে প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রায় নেই, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ্রদ আছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে, কিন্তু লোনারকে ঘিরে আছে মহাদেব মন্দির, গণপতি মন্দির, সূর্য মন্দির, দরগা। লাদাখের প্যাংগং লেকের কাছে নোনাজলের ডোবা ৎসো-কার লেক রামসার তালিকায় ঢুকে গিয়েছে। ভারত-চিন সংঘর্ষ অঞ্চল হিসেবে এর প্রভূত গুরুত্ব। দক্ষিণ লাদাখের রামসার ৎসো মোরিরি যদিও প্রায় ভেন্টিলেশনে। অথবা, বহু দিন ধরে মথুরা শোধনাগারের নিকাশি ও জঞ্জালে জর্জরিত উত্তরপ্রদেশের সুরসাগর লেক। হঠাৎ তার চার পাশে উঁচু পাঁচিল তুলছেন শোধনাগার ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। সরকারও আচমকা বাফার এরিয়া ১০ বর্গকিলোমিটার কমিয়েছে, স্লথ-বেয়ারের বসতির জায়গায় নাকি উঠবে স্বল্প-মূল্যের আবাসন। রামসার ক্ষেত্র ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় তা অনুল্লিখিত।

প্রশ্ন আরও আছে। নোনা জলাধার, খাঁড়ি বা মোহনা যদি জলাভূমি না হয়, তা হলে সুন্দরবন বা ৎসো-কার রামসার হল কী করে? পশ্চিমবঙ্গে ৪৭.৫ হাজার হেক্টর জলাভূমি থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবন ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না? ইথাই বাঁধের কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়ল মণিপুরের লোকতাক লেক, কী করে ঢুকে পড়ল উত্তরাখণ্ডের আসান বাঁধ? সতেরো বছর সংগ্রামের পরেও ফ্লেমিঙ্গোদের বাড়ি নবী মুম্বই জলাভূমি কেন রামসার হল না? উত্তর বিহার জলাভূমির মাত্র এক শতাংশ কেন রামসার? সমস্যা হল, সরকারপ্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতেই রামসার কাজ করে, তথ্য যাচাইয়ের ক্ষমতা তার নেই। অতএব, সরকারও জলাভূমি সংক্রান্ত নিয়ম অদলবদল করে জৈবসম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলকে ‘উন্নয়ন’-এর কাজে লাগাতে পারে।

প্রধানত রাজনীতির অনাগ্রহেই পরিবেশ হতশ্রী। তার মূল অন্বেষণ ব্যবসা— কাঁচা টাকা। পরিবেশ-ক্ষেত্রে সে সুযোগ সামান্যই। গাছ কাটলে কাঠ বিক্রি হয়, পয়সা আসে, তাই জঙ্গলে তার নজর। পড়ে থাকা ফাঁকা জমিতেও উৎসাহের অভাব নেই, আবাসন শিল্পের সৌজন্যে। সেনাবাহিনীর প্রয়োজন বৃহৎ নির্জন এলাকা, তাই তাতেও বেশ যত্ন আছে। জলাভূমি নিয়ে মাথাব্যথা প্রায় নেই, কেননা সে জমি বুজিয়ে না ফেলা পর্যন্ত রাজনীতির লাভ নেই! কিছু টাকা আসে পর্যটনে, কদাচিৎ ভোট জোগাড়ে জলাভূমি সংলগ্ন বাসিন্দাদের তুষ্ট করতে হয়, কিন্তু সে আর এমন কী? তাই ১৯৮১ সালে বাইরের চাপের সামনে চিলিকা হ্রদ ভারতে প্রথম রামসার স্বীকৃতি পেলেও আজ পর্যন্ত জলাভূমি নিয়ে কোনও জাতীয় নীতি গঠিত হয়নি। ২০১০ ও ২০১৭ সালে কিছু নিয়ম তৈরি হয়েছে মাত্র, যদিও গত সাড়ে ছ’বছরের নতুন নিয়মাবলিতে পরিবেশের ক্ষতিই হয়েছে বেশি, ইদানীং ‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ (ইআইএ) এড়িয়ে যাওয়াও দুরূহ নয়। ইসরো দ্বারা ২,০৫,১০৩টি জলাভূমি চিহ্নিত হলেও স্বীকৃতি পেয়েছে মোটে ২৭৩টি, দেশে ১৫ মিলিয়ন হেক্টর মিটার জলাভূমি (মোট এলাকার ৫ শতাংশ) থাকলেও ৪২টা রামসারে রয়েছে মাত্র ১.০৭ মিলিয়ন হেক্টর মিটার, প্রতি বর্গকিলোটার নগরোন্নয়নে খোয়া যাচ্ছে ২৫ হেক্টর মিটার জলাভূমি, যা জঙ্গল হ্রাসের চেয়েও ৪.২ গুণ দ্রুতগতিতে হচ্ছে। অথচ, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জীববৈচিত্রের আধার জলাভূমি, জঙ্গল মাত্র ১৭ শতাংশ, জলাভূমির ‘কার্বন অ্যাডভান্টেজ’ ১২ শতাংশ বেশি, গরিব মানুষকে চার গুণ বেশি সাহায্য করে। তার পরেও বন, নগরোন্নয়ন, সেচ, কৃষি ইত্যাদি মন্ত্রকের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জলাভূমিকে, ৪২তম সংবিধান সংশোধনীতে অরণ্য কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত হলেও পুকুর ও জলাধার রাজ্য-তালিকায়। জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল-এ যাওয়ার উপায়ও নেই। এমন জরুরি বিষয়ে এতখানি নীতিহীনতার কারণ কী? এক সময়ে যাতে ধুঁকতে ধুঁকতে নিজেই শেষ হয়ে যায় জলাভূমিগুলি?

অভাব আছে প্রয়োজনীয় গবেষণারও। জলাভূমি না থাকলে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার খরচ একশো গুণ বেড়ে যাবে, নদীর জল বা বন্যার জলের ভারসাম্য তৈরি করার কিছু থাকবে না, সৈকত এলাকা থেকে ঢুকে পড়বে নোনা জল। কথাগুলো অনেকেই জানেন। এও জানেন যে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি থাকার কারণে মুম্বই-চেন্নাইয়ের মতো বন্যা এখানে হয়নি, রাজারহাট-নিউটাউনে দ্রুত নগরায়ণের ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমছে অতিদ্রুত, শুধু ‘এম্পিরিক্যাল এভিডেন্স’ বা পরীক্ষামূলক প্রমাণের অভাবে কিছু বলতে পারছেন না। বস্তি অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যে এত কম খরচে চলে, তার একটা কারণ জলের সহজলভ্যতা। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, যে জলাভূমি দারিদ্র বা ক্ষুধার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তা থেকে কত টাকা রাজস্ব আসে, তার কোনও হিসেব জিডিপি-তে নেই!

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: দীপায়ন দে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Water Body
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE