Advertisement
১১ মে ২০২৪
Primary Schools

যে ভাবে চলছে বুনিয়াদি শিক্ষা

শহরাঞ্চলের অনেক প্রাথমিক স্কুল যথেষ্ট শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও পড়ুয়ার অভাবে উঠে যেতে বসেছে!

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৫৯
Share: Save:

বোলপুরে আলাপ ভদ্রলোকের সঙ্গে। পেশা শিক্ষকতা, নেশা পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে বুনিয়াদি শিক্ষার প্রসার। লকডাউনের শুরু থেকেই স্কুল বন্ধ, সেই বন্ধের বর্ষপূর্তির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিদ্যালয়-শিক্ষার হালহকিকত নিয়ে কথা হচ্ছিল। বললেন, যাবেন আমার সঙ্গে? নিজের চোখেই দেখবেন চলুন!

পাশাপাশি দুটো গ্রাম, জরকাডাঙা ও বারিপুকুরডাঙা। বিশ্বভারতী থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। পিচরাস্তা ছেড়ে ভিতরে পা বাড়ালেই চিরাচরিত দারিদ্র-লাঞ্ছিত গ্রাম্য চেহারা। মূলত জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। লকডাউনের জন্য স্কুল বন্ধ, তবে তার অনেক আগে থেকেই তিনি ক’জন সমমনস্ক মানুষকে নিয়ে গ্রাম দুটোতে জনজাতি শিশুদের পড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওখানে কি স্কুল নেই? উনি হেসে বললেন, থাকবে না কেন? স্কুল আছে, মাস্টারমশাইও কয়েক জন, পড়াশোনা নাই। সরকারি নানা প্রকল্পের সুবাদে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের কিছুটা বিদ্যালয়মুখী করা গেলেও, বইমুখী করার কাজ অধরাই থেকে গিয়েছে।

জরকাডাঙা মৎস্য দফতরের একটা পরিত্যক্ত কমিউনিটি হল-এ ওঁর পাঠশালা। বইয়ের ঝোলা ও বগলে আসন-চাটাই নিয়ে জড়ো হয়েছে কিছু শিশু। ক্লাস ফোরের একটি বাচ্চাকে ডেকে তিনি যোগ-বিয়োগ শেখাতে শুরু করলেন। ক্লাস থ্রি-তে পড়ে যে ছেলেটি, সে বর্ণমালার সব অক্ষর লেখা শেখেনি। বারিপুকুরডাঙার স্কুলটা খোলা আকাশের নীচে, উঠোনে। কচিকাঁচাদের পাশে জাবর কাটছে গরু, উঠোনময় হাঁস-মুরগি। ছাত্রদের শিক্ষার মান জরকাডাঙার শিশুদের মতোই। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ না শিখেই কেউ ফাইভে উঠে গিয়েছে। বাংলা রিডিং পড়তে হোঁচট খাচ্ছে ক্লাস ফোরের কুসমি।

বোলপুর থেকে ফিরে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল এক প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁর স্কুল উত্তর ২৪ পরগনার গ্রামে। জানালেন, গ্রামের দিকে প্রাইমারি স্কুলে যে বাচ্চারা পড়তে আসে, তাদের বেশির ভাগই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, দরিদ্র। স্কুল থেকে মিড-ডে মিলের ভাত পায়, বছরে এক বার পোশাক, স্কুলব্যাগ, জুতো, বইপত্তর বিনা পয়সায়। বাবা-মায়েদের কাছে এটাই বিরাট পাওনা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে তাঁরা আদৌ ভাবিত নন।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদেরও তো দায়িত্ব আছে, ঠিকঠাক পড়ালে তো এমন হওয়ার কথা নয়! তিনি বললেন, গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ স্কুলে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষকসংখ্যা নিতান্ত কম। একটা প্রাথমিক স্কুলে প্রিপারেটরি থেকে ফোর পর্যন্ত ক্লাস মোট পাঁচ বা ছ’টি। অথচ শিক্ষক মাত্র এক বা দু’জন, এমন স্কুল কম নয়। আর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মানেই প্রশাসনের চোখে ভাঙা কুলো। পড়ানোর কাজ গৌণ, আসল কাজ শিক্ষা-বহির্ভূত দায়িত্ব পালন। মিড-ডে মিলের হিসেব, ভোটার তালিকা সংশোধন, ভোটের বাজনা বাজলেই বুথ লেভেল অফিসার হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার-তথ্য যাচাই, জনগণনা, মাইনরিটি স্কলারশিপের নাম নথিবদ্ধকরণ, ‘বাংলার শিক্ষা’ ওয়েব পোর্টালে ছাত্রদের মূল্যায়নের পরিসংখ্যান-সহ স্কুলের যাবতীয় তথ্য নিয়মিত আপলোড, সব করতে হয় তাঁদের। এত কিছু সামলেও শিক্ষকরা পড়ানোর চেষ্টা যে করেন না, এমন নয়। কিন্তু প্রাথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির যে পাঠ্য বিষয় ও বই, তা শিশুমনে স্বাভাবিক আগ্রহ সৃষ্টি করতে অপারগ। বুঝিয়ে বললেন, ধরুন আমাদের রাজ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, কথ্য ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখন শিশুরা যদি পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মেলাতে না পারে, তার মধ্যে কী করে আগ্রহ জন্মাবে! তার উপর পাশ-ফেল উঠে যাওয়ায় ব্যতিক্রমী দু’এক জন ছাড়া বেশির ভাগ শিশুই পড়াশোনার তাগিদ অনুভব করে না। কিছু শিখুক না শিখুক, বছর ঘুরলেই তারা পরের ক্লাসে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র অশিক্ষিত বা স্বল্প-শিক্ষিত অভিভাবকরাও বাচ্চাদের পড়াশোনার অগ্রগতি নিয়ে খোঁজখবরে অপারগ বা অনাগ্রহী।

বললাম, উল্টো ছবিটাও তো সত্যি। শহরাঞ্চলের অনেক প্রাথমিক স্কুল যথেষ্ট শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও পড়ুয়ার অভাবে উঠে যেতে বসেছে! তিনি বললেন, এ সমস্যা শহরতলিতেও। একটু সম্পন্ন বাড়ির বাচ্চারা যায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেখানে অন্তত বসার বেঞ্চ বা লেখার ডেস্ক, পাখা, পরিচ্ছন্ন শৌচাগার আছে। অথচ গ্রামাঞ্চলে বহু স্কুলে উপযুক্ত ক্লাসঘর, পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচালয়, এমনকি বিদ্যুৎও নেই। যেখানে ক্লাসরুম বা শৌচালয় আছে, সেখানে সাফাইকর্মী বা অর্থের সংস্থান নেই। বুনিয়াদি শিক্ষাকে যথার্থ সর্বজনীন করে তুলতে হলে চাই স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্য বইয়ের সংস্কার, উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষকদের শিক্ষা-বহির্ভূত কাজে ব্যবহার বন্ধ করাও আশু প্রয়োজন। নয়তো বিদ্যালয়-শিক্ষার সরকারি পরিসংখ্যান যতই উজ্জ্বল হোক, বাস্তবে অশিক্ষার অন্ধকার ঘুচবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Primary Schools
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE