১৯৯১ সালের আইনটি নিয়ে সঙ্গত ভাবেই কয়েকটি প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথমত, এই আইনটি কি আদৌ কাম্য? কোনও এক সম্প্রদায় যদি সত্যিই ঐতিহাসিক অবিচার বা হিংসার শিকার হয়ে থাকে, তবে কি তাদের সুবিচার পাওয়ার আইনি রাস্তা বন্ধ করা উচিত? দ্বিতীয়ত, আদালতের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? যদি গণতান্ত্রিক দেশের গরিষ্ঠ অংশকোনও বিষয়ে তাদের মত প্রকাশ করে, আদালতের কি সেই মতকে মান্যতা দেওয়া উচিত, না কি সংখ্যালঘুর স্বার্থ আদালতের বিবেচ্য হওয়া প্রয়োজন?
‘ঐতিহাসিক অবিচার’ নিঃসন্দেহে জটিল বিষয়। সম্রাট অশোক যুদ্ধাপরাধী, না কি ধার্মিক, প্রজাবৎসল নৃপতি? ইতিহাসের পাতায় দুই যুক্তির সমর্থনেই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। যদি কোনও ইতিহাসচিন্তক উৎকলের অধিবাসীদের উপর সম্রাট অশোকের ভয়ঙ্কর অত্যাচার এবং লাঞ্ছনার ইতিহাস নতুন করে মনে করান, যদি সেই আলোকে সম্রাট অশোককে ‘ঐতিহাসিক অবিচার’-এর দায়ে অভিযুক্ত করেন, সম্রাট অশোক সম্বন্ধে কারও কারও মূল্যায়ন পাল্টালেও পাল্টাতে পারে। কিন্তু সেই নতুন উপলব্ধির ভিত্তিতে কেউ যদি বৌদ্ধ ধর্মের যাবতীয় চিহ্ন মুছে ফেলতে নামেন, অশোকস্তম্ভ ভেঙে ফেলেন, তাতে কি উৎকলের সেই লাঞ্ছিত মানুষদের আত্মার প্রতি সুবিচার করা হবে? ৪০০ বছর আগে কোনও রাজা কারও বাড়ি-ঘর ভেঙে দিয়েছিলেন বলে আজকের দিনে যদি সেই রাজার সমধর্মাবলম্বী ব্যক্তির বাড়িতে বুলডোজ়ার চালাই, তাকে সভ্য দেশে আর যা-ই হোক, ন্যায়বিচার বলা চলে না। সে ক্ষেত্রে বর্তমানের ‘আমি’র সঙ্গে ইতিহাসের সেই ধর্মান্ধ রাজার কোনও ফারাক থাকে না।
অবিচারের আখ্যানের আর একটা সমস্যা আছে। আমরা যত পিছনের দিকে যাব, অন্যায়-অবিচারের খতিয়ান বাড়তেই থাকবে। সেই সঙ্গে সাদা-কালো, নায়ক-খলনায়ক গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ১৪০০ বছর আগে গেলে পাব এক হিন্দু রাজাকে— শশাঙ্ক— যিনি বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র বোধিবৃক্ষ ছেদ করেন; বা তারও ৭০০ বছর আগে পূষ্যামিত্র, যিনি নির্বিচারে বৌদ্ধহত্যা করেন, সম্রাট অশোক-নির্মিত সাঁচি স্তূপ, স্তম্ভ এবং বহু বৌদ্ধগুম্ফা ধ্বংস করেন। আবার আজ থেকে মাত্র ৩০০ বছর পিছিয়ে গেলে দেখতে পাব, ‘বহিরাগত’ মোগলরা ‘দেশজ বীর’ মরাঠাদের উপর অত্যাচার করছে, আবার সেই মরাঠারাই বঙ্গের নিরীহ চাষিদের উপর অবাধে লুটতরাজ চালাচ্ছে। তার ১৫০ বছর পর ইংরেজ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত দেশীয় ব্রাহ্মণ সিপাই গোমাংসমিশ্রিত কার্তুজ দাঁতে কাটতে অস্বীকার করে দেশে স্বাধীনতার প্রথম বিপ্লব ডেকে আনছেন, যে যুদ্ধের প্রতীকী নেতা হয়ে উঠছেন এক অশীতিপর মুসলমান সম্রাট। মথুরায় যে কৃষ্ণজন্মস্থান নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, সেই স্থানেই বুদ্ধ মন্দির ভেঙে হিন্দু মন্দির গড়ার ঘটনা আমাদেরই ইতিহাসের অঙ্গ। ইতিহাসের কোন নির্মমতাগুলি আমরা বেছে নেব, আর কোনগুলিকে ‘পুরনো কাসুন্দি’ বলে বাতিল করব, তা সর্বাংশেই এক রাজনৈতিক নির্বাচন।
এই বিতর্কের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে আদালতের অবস্থান বিবেচনা করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। বাবরি মসজিদের মামলায় উচ্চতম ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক রায়ে বারংবার বলা আছে যে, বাবরির বিষয়টি অন্য সমস্ত বিবাদের থেকে আলাদা— বিষয়গুলি কোনও ভাবেই সমগোত্রীয় নয়। এই রায়ে প্লেসেস অব ওয়রশিপ আইনকে এক প্রকার মান্যতা দিয়েছে আদালত— আইনটির গুরুত্ব নিয়ে দু’চার কথাও উল্লেখ করেছে তার রায়ে। এই রায়েই আদালত জািনয়েছিল যে, ইতিহাস, বা কোনও ঐতিহাসিক অন্যায়কে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমানে, বা ভবিষ্যতে কোনও দমনপীড়ন করা চলবে না। ১৯৯১ সালের আইন, ১৯৪২ সালের ইলাহাবাদ হাই কোর্টে রায়, অথবা রাম জন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান— যে কোনও যুক্তি প্রয়োগেই জ্ঞানবাপীর মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, সুপ্রিম কোর্টেই তা হয়নি। কেন, গণতন্ত্রের চিন্তকদের কাছে সেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হতেই পারে।
আইনজ্ঞরা অনেকেই দাবি করেন যে, আদালতের কাজ হল আইনের নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা দেওয়া— সেই ব্যাখ্যার মাধ্যমে কার লাভ, কার ক্ষতি, তা বিবেচনা করা আদালতের দায়িত্বের সীমায় পড়ে না। বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষিতে আদালতের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া কঠিন। কেউ বলতেই পারেন যে, আদালত যখন আইনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তখন সেই আইন প্রণয়নের কারণ, তার মাধ্যমে সমাজের কী লাভ বা ক্ষতি, তার প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থা আইনে কল্পিত আছে কি না, এই বিষয়গুলি নিয়ে সামগ্রিক চিন্তার ভার আদালতের উপরেই বর্তায়। তা না করলে সমাজের যে ক্ষতি আসন্ন, তার দায়ভার আদালতের উপরেও বর্তায়।
গত কয়েক দশকে ভারতে প্রত্যাশা জন্মেছে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদালত রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসাধারণের হয়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর হয়ে, শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলের হয়ে কথা বলবে। দেশের আইনব্যবস্থা এই প্রত্যাশা বহুলাংশে পূরণ করেছে বলেই দুর্বলের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে আদালতের উপর মানুষের আস্থা এত বেশি।
তবে, গণতন্ত্রের সঙ্কটে আদালত মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসও ভারতেই রয়েছে। আজকের ভারতবর্ষে আদালত এ বার কোন পথে হাঁটবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
আইনবিদ্যা বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস