Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Sister Nivedita

দিব্যরূপিণী প্রতিভাময়ী

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে, কোনও কাজ তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়, অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারেন। না হলে, ব্রিটেনের অভিজাত মহলের স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিপত্তি ছেড়ে কী ভাবে ভারতের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের নরককুণ্ডে ঝাঁপ দেন?

Sister Nivedita

ভগিনী নিবেদিতা। —ফাইল চিত্র।

চিরশ্রী মজুমদার 
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:২৫
Share: Save:

দেবী দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে এই হিমের পরশ লাগা শরৎ তাঁরও ঋতু। এই লগ্নেই যে তাঁর জন্ম, তাঁর মৃত্যু। কিন্তু, মৃত্যুতে মহাজীবন ফুরোয় না। তাই, প্রস্থানের শতাধিক বছর পেরিয়েও ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবদানের কূল মাপা যায় না। তার মূল কারণ কি তাঁর অন্তরালে থাকার প্রবৃত্তি, না ইতিহাসবিদদের অক্ষমতা, না কি তাঁর চিন্তা-আকাশের নাগাল পাওয়ার ব্যর্থতা— জানা দায়। তবে এর মধ্যেই আছে কিছু কিছু স্মরণলিখন, যা অ-তুলনীয়। নিবেদিতার অকালপ্রয়াণের (১৩ অক্টোবর, ১৯১১) মাসখানেক পর প্রবাসী পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে একটি শোকনিবন্ধ লেখেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিছু প্রসঙ্গে তিনি উপমার আশ্রয় নিয়েছেন, কোথাও একটিমাত্র শব্দের মধ্যে ‌অনেক তথ্য, তত্ত্ব ও ভাবের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। মানুষটি যে কেমন, এই রচনাই যেন তার সবচেয়ে সার্থক ছবিটি তুলে ধরে।

এই ‘ভগিনী নিবেদিতা’ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ ‘লোকমাতা’ অভিধাটি ব্যবহার করেছিলেন। উপাধিটি তার পর থেকে নিবেদিতার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। কিন্তু একই প্রবন্ধের উপসংহারে তাঁকে আর একটি দুর্মূল্য সম্মান দিয়ে বিশ্বকবি লিখেছেন— “এই সতী নিবেদিতাও দিনের পর দিন যে তপস্যা করিয়াছিলেন তাহার কঠোরতা অসহ্য ছিল...।” নিবেদিতাকে কেন সতীরূপে দেখছেন, তাও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। “মানুষের মধ্যে যে শিব আছেন সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন।” এই প্রতীক থেকেই আর একটি চিন্তাস্রোতের সৃষ্টি হয়। প্রচলিত বিশ্বাসে এই উমা কে? তিনি তো শক্তির অংশ, দুর্গা, উমা, পার্বতী, কালী, সতী সবই মহামায়ার নামান্তর। ব্রহ্মবাদী কবিমানসের আধ্যাত্মিক অনুভূতির আবর্ত দুর্গম মনে হলে সাদা চোখেই নিবেদিতা-জীবনীতে অসংখ্য ঘটনা, চিহ্ন ধরা পড়ে, যাতে তাঁকে কিছুতেই সাধারণ্যা মনে হয় না। কবিগুরু তাঁকে শঙ্করী বলেছেন। শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে তিনি তপস্বিনী উমা, কাদম্বরীর মহাশ্বেতা। সাদা সিল্কের আলখাল্লা, চুল চুড়ো করে বাঁধা, গলায় স্ফটিক ও রুদ্রাক্ষের মালা। টাঙ্গা থেকে ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে নামছেন।— নন্দলাল বসু বর্ণিত এই দেবোপমার আদল রয়েছে তাঁর ‘সতী’, ‘উমার তপস্যা’ ছবিতে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে, কোনও কাজ তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়, অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারেন। না হলে, ব্রিটেনের অভিজাত মহলের স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিপত্তি ছেড়ে কী ভাবে ভারতের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের নরককুণ্ডে ঝাঁপ দেন? লন্ডনে টমাস হাক্সলি, জর্জ বার্নার্ড শ’-এর বিদ্বানবর্গে তিনি সমাদৃতা। এ দেশের শিক্ষিতমণ্ডলীতেও বরণীয়া। সেই প্রগাঢ় ধীময়ী দীন-দরিদ্র পল্লিসমাজে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন— এক অতীন্দ্রিয় স্তরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা সাধারণ মানুষের অগম্য। স্বামীজিকে তাঁর প্রথম চেনার দিনগুলি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রথম সাক্ষাৎকে মনে করিয়ে দেয়। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর কালী মায়ের ‘লীলাখেলা’ ছিল ধারেভারে গীতার বিশ্বরূপদর্শনের সমতুল। সেই রূপ বিবেকানন্দও দেখেছিলেন। আর সেই রূপেরই সংস্পর্শে এসেছিলেন নিবেদিতা! যিনি ‘পূজা কোথায়!’ ‘পূজা কোথায়!’ বলে বিগ্রহ খুঁজতে এলে পূজার সার্থকতা মরমে পৌঁছাত। অস্যার্থে তিনি হিমালয়দুহিতা। হিমালয়ের কোলে ইউরোপীয় খোলসত্যাগ করে ভারতাত্মায় তাঁর নবজন্ম হয়। আর সেখানেই তাঁর মরশয্যা। নিবেদিতার অন্তিম মুহূর্তে ‘পর্বতশিখরের ঊর্ধ্বে অনন্ত আকাশ’ দেখে অবলা বসুর মনে পড়েছিল উমা-হৈমবতীর উপাখ্যান। দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে এক হিমপ্রধান দেশের মেয়ে যেন ফিরে এসেছেন পিত্রাবাসে।

কবিদৃষ্টিতে তাঁর এই দিব্যরূপে শিহরন জাগে ঠিকই, তবে আমাদের হৃদয়কে তার চেয়েও গভীরে স্পর্শ করে মানুষী নিবেদিতার আবেগ ও সংগ্রাম। মনে পড়ে, তাঁকে সেবিকা, বান্ধবী, মাতা হওয়ার আশীর্বাদ দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। কিন্তু তিনি গুরুর প্রত্যাশার পাত্র উপচে হয়ে উঠলেন পৃথিবীবিখ্যাত লেখিকা, বাগ্মী, শিক্ষাতাত্ত্বিক ও শিক্ষাব্রতী, শিল্পের দিদিমণি, বিজ্ঞানীর সহায়ক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, বজ্রধারী রাজনীতিক, ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাখ্যাতা। আজ দশভুজা বলতে কি আমরা এমনই কোনও ‘সর্বতোমুখী প্রতিভা’কে বুঝব? তাঁর অসামান্য শক্তির শ্রেষ্ঠ পরিচয় পেয়েছি তাঁর ত্যাগধর্মে। তিনি খালি পায়ে তুষারনদী পেরিয়ে গিয়েছেন মনের বলে, চোখের জলে উত্তীর্ণ হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের তাঁকে যাচাই করার অগ্নিপরীক্ষায়। উদরান্নের অংশে তাঁর গড়া বিদ্যালয়ের প্রতিপালন করেছেন, অনাহারে থেকেও রাত জেগে লিখেছেন বই, ভগ্নস্বাস্থ্যে ভারত ঘুরেছেন বক্তৃতা সফরে। বিরূপ জলবায়ুর কারণে ভুগেছেন ব্রেন ফিভারে, আর্তের ত্রাণে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ম্যালেরিয়ায়, বুঝতে পেরেছেন— সময় কমছে দ্রুত। কাজ মিটিয়ে যেতে আরও অস্থির হয়েছেন। স্বদেশবাসীর লাঞ্ছনা, ভারতীয়দের রূঢ়তা, অবহেলা সয়ে, বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে প্রাণ বাজি রেখে লড়ে তিনি নিজেকে যে ভাবে ‘নিবেদিত’ করেছেন ভারতকল্যাণে, তাতে এক মৃত্যুশীল মানবশরীর ও মননের আশ্চর্য ক্ষমতারই জয় দেখতে পাই আমরা।

মনে রাখার মতো এই কথাটিই। তিনি তো দেবী নন, তিনি মানবীই। এক রক্তমাংসের মানবী যদি এত অসাধ্য সাধন করবেন, তবে কোনও দেবীর আর ডাক পড়ে কেন! তিনিই তো প্রমাণ, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, সেবা করার জন্যও যেমন সবার উপরে মানুষ সত্য, সেবক হিসেবেও তা-ই। মানুষ যদি নিজের অন্তরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার উপাসনায় আত্মসমর্পণ করে, অন্যের জন্য নিজের সর্বশক্তি উৎসর্গ করতে চায়, তবে যে তার পক্ষে কত কিছু করা সম্ভব, নিজেকে কতখানি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব— স্বল্প জীবনের কঠোর সাধনায় সেই সহজ সত্যটুকু শিখিয়ে গিয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE