Advertisement
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Theatre

‘মারতে তো পারলে না’

অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দি ছবি লাস্ট লিয়ার-ও তৈরি হয়েছিল এর থেকেই। সেই নাটক এখন ‘মুখোমুখি’ সংস্থার প্রযোজনায় আবার।

—প্রতীকী ছবি।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৩ ০৫:৪১
Share: Save:

কত দিন বাদে হলভর্তি দর্শকের সামনে মঞ্চে ফিরলেন তিনি, কুঞ্জবিহারী চক্রবর্তী? হিসাব বলছে, প্রায় ৪০ বছর! ১৯৮৫ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কুঞ্জবিহারীর কাহিনি নিয়ে প্রথম নেমেছিল উৎপল দত্তের নাটক আজকের সাজাহান। তার পর নামে-বেনামে হরেক মাধ্যমে ফিরেছেন তিনি। অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দি ছবি লাস্ট লিয়ার-ও তৈরি হয়েছিল এর থেকেই। সেই নাটক এখন ‘মুখোমুখি’ সংস্থার প্রযোজনায় আবার।

নাটক নতুন অবতারে ফিরতেই পারে। গিরিশ ঘোষের প্রফুল্ল, শম্ভু মিত্রের দশচক্র বা উৎপলের ব্যারিকেড, যা-ই হোক না কেন! মনে আছে এই কুঞ্জবিহারীর চরিত্রে উৎপল দত্তকে। শিশিরবাবু, দানীবাবুর আমলের নট কুঞ্জবিহারী প্রায় স্থবির, স্মৃতি এবং পানীয়ের নেশায় বাঁচেন। সেই বিস্মৃত অভিনেতার কাছে হাজির তরুণ চিত্রপরিচালক সুব্রত। তাঁর ছবিতে কুঞ্জবিহারীকেই চাই। কুঞ্জবিহারী গিয়ে দেখতে পারেন, স্টার্ট-সাউন্ড-রোল ক্যামেরা-অ্যাকশনের সিনেদুনিয়ার সঙ্গে নাটকের তফাত অনেক। সিনেমায় প্রযুক্তিই আসল, অভিনেতা আর পাঁচটা জিনিসের মতোই সামান্য উপকরণ। সার্কাস থেকে পালানো এক ক্লাউনের চরিত্রে তিনি, শেষ দৃশ্যে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে হবে। কুঞ্জবিহারী শট দেন, কিন্তু পরিচালকের পছন্দ হয় না। পর দিন অভিনেতার অজানতে গড়ানে পথের গাছগুলি কাটিয়ে দেন তিনি। আহত, রক্তাক্ত অভিনেতাও থেমে থাকেন না।

সে দিন উৎপলের নাটকে যিনি ছিলেন ব্যাক স্টেজের অন্যতম কুশলী, সেই শঙ্কর চক্রবর্তী আজ কুঞ্জবিহারীর চরিত্রে। উৎপলের নাটকের মঞ্চ নির্দেশক ছিলেন মনু দত্ত, তাঁর পুত্র বিলু দত্ত আজ এই নাটকের প্রযোজক। চার দশকে বদলে গিয়েছে নাট্যভাষা, দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি। উৎপল দত্তের সময়ে দুই স্তরে বিভাজিত মঞ্চ, অডিয়ো ভিশুয়াল নেই। অথচ, আজকের নাটকে সিনেমার মতো অডিয়ো ভিশুয়াল আছে। ব্রাত্য বসু, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় থেকে বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, অবন্তী চক্রবর্তী সকলের নাটকেই! এখানেও মঞ্চে অভিনয় করছেন শঙ্কর, পর্দায় তাঁর বিশাল ক্লোজ় আপ। মঞ্চে ক্যামেরা, ট্রলি... কী নেই! শ্যামবাজারের পেশাদারি থিয়েটার মৃত, সত্য। কিন্তু বাংলা মঞ্চে এখন নাটক ও সিনেমা দুই মাধ্যমের অনায়াস যাতায়াত আরও বেশি সত্য!

সেই যাতায়াতই কি বদলে দিল দৃষ্টি? উৎপল দত্তের তিন তলার লাইব্রেরিতে বাঁধাই-করা অ্যারিস্টটল, দেকার্ত থেকে মিল, বেন্থাম। কিন্তু বই খুলতেই অন্য ছবি। বাঁধাইয়ের আড়ালে সিডনি শেল্ডন, হেডলি চেজ়, আগাথা ক্রিস্টি। “এক বার ঝড় নামে একটা সিনেমা করেছিলাম। সেখানে ডিরোজ়িয়োর লাইব্রেরি দেখাতে এগুলি কাজে লেগেছিল। সিনেমা এ রকম ফাঁকিবাজি, বুঝলে?”

উৎপলবাবুর আমলে নাটকে প্রযোজক ছিল না। লেখা থাকত, সংগঠক শোভা সেন। সংগঠক আর প্রযোজকে তফাত ঢের। “প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছি,” বলছিলেন বিলু। “আর্টিস্টদের জন্য যদি এখন ২০০ টাকা বরাদ্দ থাকে, টেকনিক্যালের জন্য ৫০০ টাকা। আগে দুটো ম্যাটাডোরেই হয়ে যেত। এখন ক্যামেরা, ট্রলি, সাউন্ড মেশিন নিয়ে যেতে পাঁচটা ম্যাটাডোর লাগে।”

ঋদ্ধি সেন এখানে সিনেমা পরিচালকের চরিত্রে। থিয়েটার যে পুরনো মদকেও কত নতুন বোতলে হাজির করতে পারে, এই চরিত্রটি তার প্রমাণ। তার যুক্তি, জার্মান পরিচালক হারজগ আমাজ়নের জঙ্গলে শুটিং শেষ করার জন্য অভিনেতাকে খুনের হুমকি দিতেও পিছপা হননি। “সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনা এখানেই উল্লেখ্য। উৎপলদার নাটকে সিনেমা পরিচালকের চরিত্রটাকে ভিলেন মনে হত। এখানে লাগে না, তার ক্রিয়েটিভ যুক্তিগুলি পরিষ্কার,” বলছিলেন বিভাস চক্রবর্তী।

কেন নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রযুক্তির হাতে বন্দি সাজাহানের এই গল্পটাই বারংবার ফিরে আসে বাংলা সংস্কৃতিতে? রুশ বিপ্লবের পর স্তানিস্লাভস্কির কথা মনে পড়ছে বিভাসবাবুর, “ওঁরা তখন নানা রকম নাটক করছেন। সেই সময়েই নামালেন ১৮৮৭ সালে চেখভের লেখা সোয়ান সং। কাল্পনিক অভিনেতা সেতলোভিদভের শেষ অভিনয়রজনী নিয়ে লেখা নাটক। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নাটকটাই বাংলায় নামিয়েছিলেন, নানা রঙের দিন।” সে তো টিনের তলোয়ার নাটকেও উৎপল উনিশ শতকের কাপ্তেনবাবুর মাধ্যমে বলেছিলেন নাট্যমঞ্চের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের কথা! “অতীত নিয়ে গদগদ হওয়ার দরকার নেই, কিন্তু তাকে সম্মান না করলে সামনের দিকে এগোতে পারবে না,” বলছেন বিভাস।

নাটকের শেষ দিকে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার পর রক্তাক্ত পাঞ্জাবি পরে আসতেন উৎপল, উইংসের দিকে যেতে যেতে বলতেন, “কিন্তু মারতে তো পারলে না।” হল ফেটে পড়ত হাততালিতে। না, মঞ্চের অভিনেতাকে শেষ করার মতো ক্ষমতা আদৌ ধরে না সিনেমা। এ বারেও হলজোড়া হাততালি। কিন্তু নাটক বনাম সিনেমার প্রথাগত ব্যাখ্যার বাইরে চার দশক আগের সংলাপ এখন যেন অন্য মাত্রায়। তুমি গদি মিডিয়া, সরকারি রক্তচক্ষু যা-ই হও না কেন, সাংবাদিকতাকে মারতে তো পারলে না! তুমি পরবর্তী প্রজন্মের কৃত্রিম যন্ত্রমেধা বা যা-ই হও, আমার আঁকা, লেখালিখি, গান গাওয়া আমারই রয়ে গেল। আমরা এক সঙ্গে মেলায় যাই, কোভিডেও প্রতিবেশীর পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ি। মারতে তো পারলে না! এগিয়ে চলছে বাংলা নাটক। নতুন প্রযুক্তিতে, নতুনতর ব্যাখ্যায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Utpal Dutta theatre artist Rituporno Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE