উত্তর কলকাতার পুরনো এক আবাসনের এক তলায় গানের ইস্কুল। সারাইয়ের কাজ চলছিল, সে কারণে ছাদে গিয়ে জল বন্ধ করতে হবে সাময়িক ভাবে। ভাড়াটিয়া মাস্টারমশাইয়ের কাছে ছাদের চাবি নেই, তা আছে বাড়ির অন্য ক’জনের কাছে। তাঁরা বিধান দিলেন, ছাদের চাবি তো সবার কাছেই থাকা উচিত, সবাইকেই দেওয়া হয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের মনে পড়ল সুচিত্রা মিত্রকে। এক বিকেলে কী এক ঝামেলায় রবিতীর্থ-র সদর দরজায় তালা, ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সুচিত্রা স্বয়ং এসে দেখলেন তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান তালাবন্ধ। অবিলম্বে সিদ্ধান্ত, সামনে গাড়ি, ট্যাক্সি যা পেলেন সবাইকে তাতে চাপিয়ে পৌঁছলেন অদূরেই, নামকরা এক ইস্কুলে। কর্তৃপক্ষের সাদর ব্যবস্থাপনায় ক্লাস শুরু হতে দেরি হয়নি সেখানে।
তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই, সুচিত্রা মিত্রও জীবনভর বলতে চেয়েছেন, ‘আপনি অবশ হলি, তবে বল দিবি তু্ই কারে?/ উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া, ভেঙে পড়িস না রে।’ চরৈবেতি মন্ত্রে অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তনের সময়েও তাঁর ভূমিকা মনে থাকবে অনেকের। ১৯৬৯ সালে প্রয়াত হলেন রবীন্দ্রভারতীর সঙ্গীত বিভাগের ডিন রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজ সামলানোর দায়িত্ব পড়ল সুচিত্রা মিত্রের উপরে। সেই পদে আর এক জন যোগ দিলেন যে দিন, সুচিত্রা তার পর আর জোড়াসাঁকোমুখো হননি। তখন ছাত্র, পরে সুচিত্রার ছায়াসঙ্গী কাশীনাথ রায়ের হাতে উপাচার্য ‘রিডার’ পদে আবেদনের একটি ফর্ম দিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্রের জন্য। কাশীবাবু ভয়ে ভয়ে সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে গেলে শিল্পী বাধ্য মেয়ের মতো স্বাক্ষর করলেন বটে, কিন্তু নিজেই কেটে দিলেন দু’জন ‘রেফারি’র নামের শূন্যস্থান। ওঁর আবার রেফারি কে! সে পদের ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। তিন মিনিটের ইন্টারভিউতে কেবল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাড়িতে কে কেমন আছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগ আলাদা ভাবে হওয়ার পিছনেও ছিল সুচিত্রার উদ্যোগ। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী, পরে বাংলায় এম এ সুচিত্রা সে বিভাগের প্রথম ‘প্রফেসর’ পোস্ট পেয়েছিলেন, এ-ও বিশেষ ঘটনা।
নেতৃত্ব দেওয়ার সহজ স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল ওঁর, জাহির করতে হত না তা। বিমানবন্দরের এক অনুষ্ঠানে কী কারণে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বেজে উঠেছিল সহযোগী যন্ত্রের উচ্চকিত হারমোনাইজ়েশন, ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল মূল মেলোডি। সবার আগে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে সময় লাগেনি সুচিত্রা মিত্রের। এমনও হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নিষেধাজ্ঞায় এক সময় টানা ছ’বছর রেডিয়োতে গান বন্ধ ছিল ওঁর। দমে যাননি— থেকেছেন গানে, ছাত্রছাত্রীদের গড়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন গণনাট্য-সহ নানা সংগঠনের সুখে-দুঃখে।
আর আহরণ করেছেন রবীন্দ্রগানের নির্যাস। বাংলাদেশে ধলেশ্বরী নদীর নৌকার মাঝি ওঁকে বলেছিলেন, এই হল রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতার ধলেশ্বরী। বিস্মিত, মুগ্ধ সুচিত্রা সবিস্তারে লিখেছেন সেই ঘটনা— সাধারণের মাঝে কী ভাবে বেঁচে বিশ্বকবি। এই সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলেছে তাঁর গানে, মনের ছায়াতলে। তাই না নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখতে পারেন, “আকাশ যখন চক্ষু বোজে,/ অন্ধকারের শোকে/ তখন যেমন সবাই খোঁজে/ সুচিত্রা মিত্রকে/ তেমন আবার কাটলে আঁধার/ সূর্য উঠলে ফের/ আমরা সবাই খোঁজ করি কার?/ সুচিত্রা মিত্রের।” শুধু সঙ্গীতের উত্তরসাধনা নয়, গানের সংস্কৃতির ইতিবাচক দিশাও তৈরি করেছে তাঁর ভাবনা। আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলনে বাঙালি গাইয়েরা যখন খেয়াল ঠুংরি বলি-টলিউডি ফিউশন গানে ব্যস্ত, তখন আমজ়াদ আলি খান সরোদে ধরেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’: জানান, এ তিনি শিখেছেন সুচিত্রা মিত্রের কাছে, তাঁর গান শুনে।
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’, ‘নহ মাতা, নহ কন্যা’, ‘নৃত্যের তালে তালে’, ‘দুই হাতে— কালের মন্দিরা’... এমন বহু গানে ব্যক্তিত্বের যে ছাপ সুচিত্রার কণ্ঠে, তা একাধারে ধ্রুপদী ও আধুনিক। রবীন্দ্রগানের এমন অনেক সাধক আছেন, রেকর্ডে গাওয়া পরিবেশনে সময়ের ছাপ থেকে যাঁরা বেরোতে পারেন না। শুনে বুঝতে সময় লাগে না, এ হল ফেলে আসা দিনের সুরনির্ঝর। সুচিত্রা মিত্র কিন্তু সময়কে টপকেও সমসাময়িক। যখন চণ্ডালিকা-য় শোনাচ্ছেন, “হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব’লে গেলেন তিনি,/ তিনি আমার আপন জাতের লোক।/ আমি চণ্ডালী, সে যে মিথ্যা, সে যে মিথ্যা,/ সে যে দারুণ মিথ্যা”— তখন মনে হয় এই সময়ের ভারতে জাতপাতের বলি এক রমণীর থেমে-যাওয়া জীবনের করুণ ভাষ্যকার যেন তিনি। ভাবতে ভাল লাগে এই সময়ের জনপ্রতিরোধেও বাজছে তাঁর গান— ‘যদি ঝড়বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—/ তবে বজ্রানলে/ আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে।’ ওঁর কণ্ঠের দীপ্ত রবীন্দ্র-উচ্চারণ ভরসা জুগিয়ে যাবে এমন ভাবেই, জন্মশতবর্ষের মাইলফলক পেরিয়ে— বাংলা ও বাঙালির সমাগত ও অনাগত ভবিষ্যতেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy