Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Bengali Language

সমস্যা ধ্বনিরূপ নিয়েই

শব্দের শুরুতে উচ্চারিত ‘অ্যা’ ধ্বনি, উদাহরণ: যেমন, কেন, দেখো ইত্যাদি বোঝাতে কোনও মান্য রীতি প্রচলনের চেষ্টা এখনও সুদূরপরাহত।

—প্রতীকী ছবি।

আকাশ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৩
Share: Save:

মাঘ ১৩৮৪। বই হিসাবে প্রকাশিত হল চাঁদ বণিকের পালা। শম্ভু মিত্র তার ভূমিকায় লিখলেন “চ, ছ ও জ-এর উচ্চারণ বহু অতীত থেকে প্রচলিত এক ধরনের উচ্চারণের মতো একটু শ বা ইংরেজি ‘Z’-এর কাছ ছুঁয়ে। ধ্বনিশাস্ত্রের চিহ্ন দিয়ে সঠিক উচ্চারণ লেখা যদি-বা যায়, সেটা দেখতে ভালো নয় আর সাধারণ পাঠকের পক্ষে পড়াও কঠিন। তাই এগুলো পাঠকের ওপরেই ছাড়তে হয়।” বাংলা বানানে উচ্চারণের প্রকৃত রূপ ধরার এই সমস্যা অবশ্য অনেক আগেই অমরত্ব দান করেছিলেন পরশুরাম, গড্ডলিকা-র ‘চিকিৎসা-সঙ্কট’ গল্পে তারিণী কবিরাজের মুখে: “হয়, Zানতি পার না।”

গড্ডলিকা প্রকাশের এগারো বছর পরে, ১৯৩৫ সালে রাজশেখর বসু যখন ‘বানান সংস্কার সমিতি’র সভাপতি, তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রথম বানান সমিতির গৃহীত মূল নীতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: “বানান যথাসম্ভব সরল ও উচ্চারণমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু উচ্চারণ বুঝাইবার জন্য অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য এবং প্রচলিত রীতির অত্যধিক পরিবর্তন উচিত নয়।” অনেক আলোচনার পরেও ইংরেজি ‘জ়েড’ বর্ণের উচ্চারণ বোঝাতে জ-এর নীচে বিন্দু ব্যবহারের প্রস্তাব অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছিল। পরবর্তী কালে বাংলাদেশে এই সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছিল ‘জ়েড’ উচ্চারণের ক্ষেত্রে ‘য’ ব্যবহার করে (যেমন, মযহারুল)। কিন্তু ‘য’ বর্ণটি সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত হয় ‘ইয়’, এবং বাংলা শব্দভান্ডারে তৎসম শব্দের প্রাবল্যের কারণে এই চেষ্টা সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গত কয়েক বছর যাবৎ ‘জ’-এর নীচে বিন্দু ব্যবহার চালু হয়েছে, প্রধানত সংবাদপত্রের উদ্যোগে; এখন কম্পিউটারে ইউনিকোড ফন্ট ব্যবহার করে ‘জ়’ লেখা সম্ভব, লেখা যায় মোবাইলেও। ভেবে দেখা যেতে পারে, উচ্চারণের স্বার্থে ‘চ’, ‘ছ’-এর ক্ষেত্রেও এই রীতির প্রয়োগ উচিত ও সম্ভব কি না।

শব্দের শুরুতে উচ্চারিত ‘অ্যা’ ধ্বনি, উদাহরণ: যেমন, কেন, দেখো ইত্যাদি বোঝাতে কোনও মান্য রীতি প্রচলনের চেষ্টা এখনও সুদূরপরাহত। রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা সত্ত্বেও প্রচলিত হতে পারেনি ‘অ্যা’ উচ্চারণ বোঝাতে মাত্রা সমেত এ-কার () ব্যবহারের রীতি। পেজমেকার-এ কাজ করলে মাত্রা-সহ এ-কার লেখা যায় কিন্তু শতচেষ্টাতেও তা লোকপ্রিয় কোনও ইউনিকোডের হরফে সম্ভব নয়।

শম্ভু মিত্র চাঁদ বণিকের পালা-য় লিখেছিলেন: “এক বিশিষ্ট রীতির অনুসরণে লেখা হয়েছে ‘ে’-এ বোঝাতে আর ‘’— এ্যা বোঝাতে। শব্দের শুরুতে।” ‘বিশিষ্ট রীতি’টি কী, তা বুঝতে বেশি কষ্টে‌র দরকার নেই। বাংলা মুদ্রণে মাত্রাহীন ‘এ’-কার ও মাত্রাযুক্ত ‘এ’-কারের দু’টি ভিন্ন রূপ রবীন্দ্রচিন্তাপ্রসূত। সহজপাঠ দ্বিতীয় ভাগের শুরুতেই দু’রকম ‘এ’-কারের ব্যবহার বর্ণনা করে লেখা আছে: ‘রবীন্দ্রনাথের মুদ্রিত রচনায় শব্দের প্রথমে ‘’ বসিয়ে সর্বদা একটি বিশেষ উচ্চারণ বোঝানো হয়ে থাকে। দখো=দ্যাখো। সন=স্যান। বলা=ব্যালা।’

বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি ৭টি (ই, এ, এ্যা বা অ্যা, আ, অ, ও, উ) হলেও ‘এ’-কারের উচ্চারণের রূপ দু’টি: সংবৃত উচ্চারণ (‘এ’ ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ অর্থাৎ ‘এ’) ও বিবৃত উচ্চারণ (‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ ‘এ্যা’)। যেমন ‘মেলা’ শব্দটি মাত্রাহীন ‘এ-কার দিয়ে লিখিত হলে, সেই ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে সংবৃত বা স্বাভাবিক; ‘জেলা’ শব্দের ‘এ’ ধ্বনির মতো। যেমন: দেবী, সেরা, সেই, বেদনা, মেয়ে। পাশাপাশি শব্দের প্রথমে মাত্রাযুক্ত ‘এ’-কার হলে ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে বিবৃত; যেমন ‘মেলা’র স্বাভাবিক উচ্চারণ হয় ‘ম্যালা’ বা ‘ঠেলা’-র ‘ঠ্যালা’। ‘কেমন’, ‘যেমন’, ‘যেন’, ‘ফেনা’ ইত্যাদি। এই উচ্চারণ-সমস্যা দূর করতে, বা সদ্যপড়ুয়া শিশুদের বা তাদের পড়াচ্ছেন যাঁরা তাঁদের যাতে উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধা না হয়, সহজপাঠ-এ মুদ্রিত হয়েছিল ‘বাটি হাতে এ ঐ/ হাঁক দয় দে দৈ’ বা ‘খলা সেরে ঘরে ফিরে যাব। দেরি হবে না।’ শুধু সহজপাঠ নয়, বিশ্বভারতী মুদ্রিত রবীন্দ্র-রচনাবলী আগাগোড়া ছাপা হয়ে আসছে এই রীতি মেনেই। যে বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ও সহজপাঠ নিয়ে এখনও এত সংবেদনশীল, সে কেন কোনও দিন এই এ-কারের তারতম্যের বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না কে জানে! আজ ‘আল্লা ম্যাঘ্‌ দে’ লিখতে ম-এর আগে মাত্রাযুক্ত এ-কার’এর বদলে ম-এর পরে য-ফলা ব্যবহার করতেই নিঃসন্দেহে স্বচ্ছন্দ একশো জনে নিরানব্বই জন।

বানান ও উচ্চারণের অসঙ্গতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে ভেবেছিলেন। রাজশেখর বসুকে লিখেছিলেন, “ভেবে দেখলে বাংলাভাষায় সংস্কৃত শব্দ একেবারেই নেই। যাকে তৎসম শব্দ বলি উচ্চারণের বিকারে তাও অপভ্রংশ পদবীতে পড়ে। সংস্কৃত নিয়মে লিখি সত্য কিন্তু বলি শোত্তো। মন শব্দে যে কেবল বিসর্গ বিসর্জন করেছে তা নয় তার ধ্বনিরূপ বদলে হয়েছে মোন।”

সমস্যা তো ভাষার ধ্বনিরূপ নিয়েই। যে কারণে শম্ভু মিত্রকে তাঁর নাটকে “অসমাপিকা ক্রিয়াপদের মধ্যে যেখানে উচ্চারণ লিখিত স্বরবর্ণের ঠিক— য় নয়, আবার— ই-ও নয়, মাঝামাঝি যেমন, করে— কোইরে বা কোয়রে নয়, সেই স্বল্পস্বর বোঝাতে শব্দের অন্তে ‘ ’ (য-ফলা) ব্যবহার’ করতে হয়েছিল। যেমন: কর‌্যে, বস্যে, কেট্যে, থুয়্যে বা এস্যে। তেমনই: কর‌্যেছি, চল্যেছে। আসলে ‘অপিনিহিতি’ আর ‘অভিশ্রুতি’ নামক দু’টি স্টেশনের মধ্যবর্তী হল্ট-এর কোনও নাম বাংলা ব্যাকরণের পৃষ্ঠায় এখনও লিখে উঠতে পারেননি কেউ। আর যার স্বীকৃতিই নেই, তার আবার বানানবিধি! প্রান্তজনের মুখের কথার আদতে কোনও মূল্য নেই বলেই হয়তো!

ভরসা ও শঙ্কা এক সঙ্গে জাগে, যখন দেখি রবীন্দ্রনাথ বলছেন: “এই কথাটি বলতে চাই বানানের বিধি পালনে আপাতত হয়তো... আমরা ‘বাধ্যতামূলক’ নীতি অনুসরণ করে একান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে যোগ দেব, কিন্তু এই দ্বিধাগ্রস্ত মধ্যপথে ব্যাপারটা থামবে না। অচিরে এমন সাহসিকের সমাগম হবে যাঁরা নিঃসঙ্কোচেই বানানকে দিয়ে সম্পূর্ণভাবেই উচ্চারণের সত্যরক্ষা করবেন।” কবে কোন পথে তা হবে, কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE