অভিমুখ: প্রাপ্য এবং স্বীকৃতির দাবিতে সমবেত আশাকর্মীরা। দক্ষিণ দিনাজপুর, মার্চ ২০২৪। ছবি: অমিত মোহান্ত।
সম্প্রতি কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’দিনের একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন হয়েছিল। আলোচনার বিষয়: ‘দেশের খোঁজ’। কয়েক পর্বে বিন্যস্ত সেই সভাগুলির একটিতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। মূল্যবান সুযোগ। মূল্যবান, কারণ এমন সভায় কমবয়সি ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি হওয়ার, তাঁদের কথা শোনার সম্ভাবনা থাকে। যে সমাজ, যে দেশ, যে পৃথিবী তাঁদের সামনে, তাকে নিয়ে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণতরুণীরা কী ভাবছেন, তার কিছু আভাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের ভুবনে সেটা তো খুব সুলভ নয়! এ-তল্লাটে বয়স্কতন্ত্রের দাপট অতি প্রবল। আমাদের সভায় সমাবেশে, আলোচনার চক্রে, সান্ধ্য বিতর্ক বা তরজার আসরে যে কথাসরিৎসাগর ক্লান্তিহীন গতানুগতিকতায় শ্রোতাদের কানে এসে আছড়ে পড়ে এবং অনন্ত ফেনার পুঞ্জ সৃষ্টি করে চলে, তার প্রায় ষোলো আনাই বয়স্কদের সৃষ্টি। সেখানে অল্পবয়সিদের, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের ডাক পড়ে না, ডাক পড়লেও তাঁরা খুব একটা আসেন না, একান্ত বাধ্য হয়ে এলেও তাঁদের কথা বলার সুযোগ বা পরিবেশ দেওয়া হয় না— এমনকি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরেও তাঁদের অনেক সময়েই শ্রোতার ভূমিকায় সীমিত রাখা হয়। সে-দিনের ওই সভাটিতে যাওয়ার পিছনে অন্য অভিজ্ঞতার প্রত্যাশা কাজ করেছিল।
সেই প্রত্যাশা ষোলো আনা মেটেনি বটে, কিন্তু ষোলো আনা অপূর্ণও থাকেনি। নির্ধারিত সময়ের সংক্ষিপ্ত অবকাশে কয়েক জন তরুণ সহনাগরিকের নানা প্রশ্ন এবং মন্তব্য শোনার সুযোগ মিলেছিল। আর তার পাশাপাশি আরও অনেকগুলি নিবিষ্ট, আন্তরিক, উজ্জ্বল মুখ ভরসা দিয়েছিল, এই অন্ধকারে যে ভরসার দাম অপরিসীম। তরুণ সহনাগরিকদের সুস্পষ্ট প্রশ্ন, মন্তব্য এবং সমালোচনাই তো নতুন করে ভাববার উৎসাহ জোগাতে পারে, যে উৎসাহ এখন বেঁচে থাকার বড় রসদ।
যেমন সে-দিনের একটি প্রশ্ন। কথা হচ্ছিল এই ভয়ঙ্কর সমকালকে নিয়ে— রাষ্ট্র এবং দেশের অভিসন্ধিমূলক সমীকরণ, দেশপ্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তার আগ্রাসন, হিন্দুত্বের কড়াপাকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য নির্মাণ করে তাকে গণতন্ত্র বলে চালানোর কৌশল, সেই আধিপত্য বিস্তারের মতলবে সংখ্যালঘুর প্রতি অকল্পনীয় বিষোদ্গারের কদর্য বিভীষিকা, তীব্র অসাম্যের ধারক ও বাহক অর্থনীতিকে উন্নয়ন নামক বটিকা হিসাবে গিলিয়ে দেওয়ার কূটবুদ্ধি এবং সেই অসাম্য দূর করার ক্ষীণতম প্রস্তাবকেও ‘আরবান নকশাল’ বা ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে আক্রমণ করার সম্পূর্ণ অশিক্ষিত ও জনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতা— এই সব নিয়ে। সেই কথোপকথনের মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন এক তরুণ। প্রশ্ন তুললেন তিনি। প্রশ্নের মর্মার্থ: এটা এখন পরিষ্কার যে, অতিকায় পুঁজির ধামাধারী অসহিষ্ণু সিক্স-প্যাকওয়ালা সংখ্যাগুরুতন্ত্রের অতিকায় প্রকল্পটি এ দেশের বহু মানুষকে আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে; কিন্তু তার মোকাবিলা করতে হলে তো পাল্টা কোনও বড় আকারের প্রকল্পের কথা আমাদের ভাবা দরকার; সেটা আমরা কী ভাবে ভাবব, কী ভাবে তা লোকের কাছে পেশ করব?
কেবল প্রশ্নের কথাগুলো নয়, তার সুরটিও নির্ভুল ভাবে চিনিয়ে দিয়েছিল এক অস্থিরতার কণ্ঠস্বরকে। এ হল সেই অস্থিরতা, যার তাড়না সচল থাকলে এমন প্রশ্ন আর নিছক এক ব্যক্তির প্রশ্ন থাকে না, হয়ে ওঠে এক কঠিন সময়ের তীব্র ও তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যাকে ‘নিড ফর ইমপেশেন্স’ বলেন, সেই অধৈর্য হওয়ার প্রয়োজনের কথাই যেন ঘোষণা করে সেই স্বর। সে বলে: সমালোচনা, প্রতিবাদ, বিশ্লেষণ তো হল অনেক, এখন তবে কী করতে হবে? এই উৎকট আধিপত্যবাদের তন্ত্রধারকরা হিন্দু-ভারতের দশাসই প্রতিমাকে সামনে রেখে যদি বহু মানুষকে বিভ্রান্ত এবং মোহগ্রস্ত করে, তার বিপরীতে কোন মূর্তি তুলে ধরতে পারি আমরা, যা তাঁদের দৃষ্টি এবং মনকে আকর্ষণ করবে?
এখানে একটা প্রতিপ্রশ্ন উঠতেই পারে। একটা মূর্তির উল্টো দিকে কেন আর একটা মূর্তি দাঁড় করাতে হবেই? ওদের ‘আইডিয়া অব ইন্ডিয়া’র বিপরীতে আর একটা সামগ্রিক ভারত-দর্শন খাড়া না করলে চলে না— এমন ছকে নিজেদের বাঁধতে হবে কেন? যদি তেমন কোনও বড় আকারের বিকল্প খাড়া করতে আমরা না পারি বা না চাই, কেবলমাত্র দুঃশাসনের প্রতিবাদ করাটাই কি প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কর্তব্য হিসেবে যথেষ্ট হতে পারে না? সর্বগ্রাসী একাধিপত্যের নির্মীয়মাণ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রতিমাকে ভাঙার লড়াই নিজেই তো খুব বড় কাজ। একটা স্তরে, এবং একটা স্তর অবধি, কথাটা অবশ্যই সত্য। কেবল সত্য নয়, গুরুত্বপূর্ণও বটে। হিন্দুত্ববাদী অ-গণতন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বরূপ উন্মোচন করা অত্যন্ত জরুরি, জরুরি তার তন্ত্রসাধকদের প্রতিটি পদক্ষেপের সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, কঠোর সমালোচনা, নিরন্তর প্রতিবাদ। সিএএ-এনআরসি, নির্বাচনী বন্ড বা বেছে বেছে বিরোধীদের ঘরে হানাদারি থেকে শুরু করে রামলালার কপালে সূর্যের আলো ফেলার মামুলি কেরামতিকে একাধারে অলৌকিক মহিমা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রমাণ বলে চালানোর অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা চমক অবধি যে অজস্র অনাচারের বেসাতি চলছে, তার প্রকৃত রূপটিকে তথ্য দিয়ে যুক্তি দিয়ে নিরন্তর জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা অবশ্যই জরুরি।
জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট কি? শাসকের অনাচারগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই, যাঁদের জনসাধারণ বলা হয় তাঁরা দল বেঁধে শক্ত হাতে দড়ি ধরে টান মারবেন এবং দুঃশাসন খানখান হবে? সংশয় হয়। এই সংশয়ে আমজনতার বোধবুদ্ধির প্রতি কোনও কটাক্ষ নিহিত নেই। সাধারণ মানুষের তথাকথিত ‘প্রজ্ঞা’ ব্যাপারটা ঠিক কী, তা কোনও দিনই বুঝিনি, কিন্তু তাঁরা তাঁদের জীবনের দৈনন্দিন লড়াইয়ের বাস্তব থেকে যে কাণ্ডজ্ঞান অর্জন করেন, তার দাম কোনও প্রজ্ঞা-টজ্ঞা দিয়ে মাপা যায় না। সেই কাণ্ডজ্ঞানের জোরেই, প্রতি দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তাঁরা বরাবর নিজেদের বুদ্ধি ও বোধ দিয়ে বিচার করে এসেছেন, এখনও অন্য রকম হওয়ার কারণ নেই— ধর্মান্ধতা বা অন্ধভক্তি অধিকাংশ মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে, তার কোনও প্রমাণ আমরা আজও দেখিনি।
কিন্তু মূল সঙ্কট সেখানেই। বিত্তহীন ক্ষমতাহীন সুযোগবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রতি মুহূর্তে তাঁদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, দেশ বা রাজ্য বা শহর কিংবা গ্রাম কী ভাবে চলবে, সে বিষয়ে তাঁদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, তাঁদের ইচ্ছা বা প্রয়োজনের কোনও মূল্য নেই, তাঁদের ভূমিকা বড়জোর প্রার্থী তথা গ্রহীতার, উপরতলার দাতারা যা দেবেন সেটুকুই দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে তাঁদের প্রাপ্য। শাসকের দাপটে শাসিতের এই ক্ষমতাহীনতা নতুন নয়, কিন্তু গত দুই বা তিন দশকে সাধারণ মানুষের ‘এজেন্সি’ বা নিজস্ব সামর্থ্য উত্তরোত্তর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে, নাগরিক আরও আরও প্রবল ভাবে প্রজায় পরিণত হয়েছেন, উপরওয়ালারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্তঃসার গ্রাস করে নিয়েছেন, পড়ে আছে তার খোলস। এমন গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের নায়কনায়িকারা যদি ক্রমশই নিজেদের ছাড়িয়ে বড় এবং আরও বড় হয়ে উঠতে থাকেন, আর তাঁদের যাবতীয় অন্যায়কে দেখে, জেনে এবং বুঝেও নাচার প্রজারা বলেন: ‘কী আর করা’, অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অতএব, এই কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিষ্ক্রমণের প্রথম শর্ত হল শ্রমজীবী মানুষকে রাজনীতির সামনে নিয়ে আসা। এ কেবল তাঁদের জন্য, তাঁদের হয়ে, তাঁদের প্রতিনিধি, মুখপাত্র বা ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে তাঁদের সমস্যার কথা বলার ব্যাপার নয়, এ হল রাজনীতির ‘বিষয়’ থেকে তাঁদের রাজনীতির ‘বিষয়ী’ হয়ে ওঠার প্রশ্ন।
তার মস্ত সুযোগ আছে এই মুহূর্তের বাস্তবতার মধ্যেই। ক্ষমতার দাপটে বিপন্ন, বিপর্যস্ত, দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবীরা তাঁদের ন্যূনতম প্রাপ্য আদায়ের দাবিতে দেশের নানা বিন্দুতে নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে সেই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, কিছু কিছু সাফল্যও পাচ্ছেন, যে সাফল্য তাঁদের মানসিক শক্তি দিচ্ছে, ভরসা দিচ্ছে, তাঁরা আরও প্রত্যয়ের সঙ্গে জোট বাঁধছেন। মিড-ডে মিল সহায়িকা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশাকর্মী থেকে শুরু করে ডেলিভারি কর্মীদের আন্দোলন এক নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা তুলে ধরে। আবার সেই সম্ভাবনারই অন্য এক রূপ দেখা যায়, যখন ক্ষমতার মার খেতে খেতে নাজেহাল মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন: ‘আর নহে, আর নয়’— সাম্প্রতিক সন্দেশখালি এই সম্ভাবনার একটি নজিরমাত্র। শাসকরা এই লক্ষণগুলি পড়তে ভুল করেননি, সেই কারণেই তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে সহসা ‘মার্ক্সবাদী’দের উদ্দেশে এমন গগনভেদী হুঙ্কার নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ওই জোট-বাঁধা এবং ঘুরে-দাঁড়ানো শ্রমজীবীদের যদি আমাদের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি তার চালকের আসনে নিয়ে আসতে পারে, আরও অগণন সহনাগরিককে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং জোট বাঁধার তাগিদ ও সাহস সরবরাহ করতে পারে, রাজনীতির মোড় ঘুরবেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রটি যে প্রতিস্পর্ধী প্রকল্পের খোঁজ করতে চেয়েছিলেন, তার শেষ কোথায় জানা নেই, কিন্তু সেই সন্ধান শুরু করতে হবে এই সম্ভাবনাগুলি থেকেই। নির্বাচনী মরসুমেই সে-কাজের সুবর্ণসুযোগ ছিল, কিন্তু গড্ডলিকাপ্রবাহে সেই সুযোগ কাজে লাগানোর কথা বোধ করি কেউ ভাবতেও রাজি নয়। বেশ, আমরা ভোটের পরে ভাবব কি? ভোটের অঙ্ক কষে যে ফলই মিলুক, জনসাধারণকে রাজনীতির বিষয় থেকে বিষয়ীর ভূমিকায় নিয়ে আসার কাজটা তো থেকেই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy