Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Lok Sabha Election 2024

ব্যক্তিপ্রচার আর ব্যক্তিতন্ত্র

গত ১০ বছরে বিজেপি সরকারের নানা সাফল্যের খতিয়ান প্রচার করা সত্ত্বেও কেন এই মোদী-নির্ভরতা; কেন ‘বিজেপি কি গারন্টী’ না বলে ‘মোদী কি গারন্টী’ বলে প্রচার করতে হচ্ছে?

Prime Minister Narendra Modi releases the BJP\\\\\\\'s election manifesto ‘Sankalp Patra’ at the party headquarters, in New Delhi

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৪ ০৭:৩৪
Share: Save:

এ বারের নির্বাচনের আগে ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের যে ইংরেজি ভাষার ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে, সেটিতে রয়েছে ৭৮টি ছবি, যার ৫৩টিতেই রয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, কোথাও একা, কোথাও অগ্রভাগে। এই ৭৬ পাতায় মোট ৬২ বার ‘মোদী’ শব্দটি লেখা রয়েছে, আর ‘মোদী কি গারন্টী’ ২৫ বার। আশ্চর্য সমাপতন যে, ওই ম্যানিফেস্টোতেই বিজেপির ‘আমাদের দর্শন’ নামক শিরোনামের তলায় প্রথম লাইনে লেখা— বিজেপির শক্তি হল তাদের ক্যাডাররা এবং তারা কোনও ব্যক্তি বা নেতার উপর নির্ভরশীল নয়!

বিজেপির এই সম্পূর্ণ ‘মোদীময়’ লোকসভা নির্বাচনের প্রচার নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। প্রথমত, গত ১০ বছরে বিজেপি সরকারের নানা সাফল্যের খতিয়ান প্রচার করা সত্ত্বেও কেন এই মোদী-নির্ভরতা; কেন ‘বিজেপি কি গারন্টী’ না বলে ‘মোদী কি গারন্টী’ বলে প্রচার করতে হচ্ছে? তবে কি খতিয়ানের দুধে বেশ খানিকটা জল মেশানো আছে? বর্তমানে পৃথিবী জুড়েই একমেবাদ্বিতীয়ম্ পপুলিস্ট নেতা বা নেত্রী ইকোয়াল টু দল ও দেশ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বস্তুত, ১৯০০ সাল থেকে বর্তমান সময় অবধি পৃথিবী জুড়ে পঞ্চাশের বেশি এমন পপুলিস্ট প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেছেন। গবেষণা বলছে যে, ‘আমিই সব’ মডেলে প্রশাসন চালানো নেতারা ১৫ বছর শাসন করার পর দেশগুলির জিডিপি বা গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট গড়পড়তা প্রায় ১০ শতাংশের উপর নেমে গেছে। পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে যে, স্বাধীন ও ন্যায্য নির্বাচন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আদালতের ভূমিকাও এমন প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় নিম্নগামী হয়। বস্তুত পপুলিস্ট নেতা-নেত্রীদের আন্তর্জাতিক তালিকায় ভারতের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদীর নামই উজ্জ্বল। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ-যুদ্ধ জয়ের পর দেশে ও বিদেশে ইন্দিরা গান্ধী এতটাই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন যে, অসমের প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা দেবকান্ত বরুয়া বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ইজ় ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ় ইন্ডিয়া’। আজকের ‘মোদী কি গারন্টী’-তে, বা বিশ্বগুরু আখ্যায় যেন তারই প্রতিধ্বনি। মনে রাখতে হবে, লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চার বছরের মধ্যে এমনই পরিস্থিতিতে পড়েন যে, তাঁকে দেশের উপর দখল রাখতে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়; যা এখনও অবধি কংগ্রেস দল ও দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি কালো চিহ্ন বলে পরিগণিত। এ বারে মোদী ৪০০ পার করার যে স্লোগান দিয়েছেন, তা গত ৭৭ বছরের স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এক বারই ঘটেছিল, যখন ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ৪০৪টি আসন পেয়েছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ওই রকম জনপ্রিয়তার চুড়োয় থাকা প্রধানমন্ত্রী বফর্স আর্থিক কেলেঙ্কারিতে বিদ্ধ হয়ে ১৯৮৯ নির্বাচনে মাত্র ১৯৭টি আসন জেতেন ও ক্ষমতা হারান।

রামমন্দির তৈরি, ৩৭০ ধারার বিলোপ, পাকিস্তানকে সময়োচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবি ইত্যাদি ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ মডেলকে জল-বাতাসা দিলেও পাশাপাশি প্রশ্নও আছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের সঙ্গে দুর্নীতির যোগসাজশের অভিযোগ, নোট বাতিল থেকে আরম্ভ করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পাল্টানোর চেষ্টার অভিযোগ, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের উপর চাপ রাখার অভিযোগ বার বার উঠছে, দেশে তো বটেই, বিদেশেও। পাশাপাশি বিশ্ব মানবোন্নয়ন সূচকে ১৩৪তম, বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে ১০৮তম, বিশ্ব সুখের সূচকের ক্ষেত্রে ১২৬তম, বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ১১১তম, দুর্নীতির সূচকে ৯৩তম, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৬১তম ও পরিবেশের ক্ষেত্রে শেষতম স্থান প্রাপ্তি মোটেই দেশের শাসনব্যবস্থার পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়। এ সবের পাশাপাশি ভারত বিশ্ব উদ্ভাবনী সূচক ও বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক সূচকে ৪০তম, বিশ্ব সামরিক শক্তিতে চতুর্থ ও বিশ্ব জিডিপি-তে পঞ্চম স্থান পেয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই ওই সব উন্নয়ন দেশের গড়পড়তা মানুষের জীবনযাত্রাকে খুব একটা পাল্টাতে পারেনি।

কেউ বলতে পারেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়কের মতো নেতা তো একই মডেলে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছেন বা করছেন। মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক দলের রাজ্য শাসন আর একটি সর্বভারতীয় দলের দেশ শাসন এক কথা নয়। আর সেখানেও ক্ষেত্রবিশেষে একনায়কত্বের উপসর্গগুলি দেখা যাচ্ছে। ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোয় আঞ্চলিক দলগুলি ঐতিহাসিক ভাবেই বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যে কারণে জয়ললিতার মৃত্যুর পর এআইএডিএমকে উঠে যাওয়ার দাখিল হয়েছে, নবীন পট্টনায়কের পর কে বিজু জনতা দল চালাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-পরবর্তী তৃণমূল কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়ে। উল্টো দিকে কংগ্রেস যতই গান্ধী পরিবারের উপর নির্ভরশীল হোক না কেন, সেখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ সামনের সারির নেতারা ছিলেন ও আছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ও ছিল একই চিত্র। সেখানেই প্রশ্ন উঠছে যে, এই ‘মোদী বিনা গতি নেই’ রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি স্বল্প পরিসরে বিজেপির জন্য স্টেরয়েডের কাজ করলেও দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে দুর্বল করে দেবে না তো? পাশাপাশি দেশকেও? নির্বাচনে বিজেপি জিতলেও প্রশ্নগুলি রয়ে যাবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE