Advertisement
০৭ নভেম্বর ২০২৪
RG Kar Protest

রাজনীতি বাদ দিয়ে আন্দোলন?

জুনিয়র চিকিৎসকরা যে আন্দোলন করছেন, তা কি চরিত্রে রাজনৈতিক? প্রশ্নটি শুনেই অনেকে এমন ভাবে প্রতিবাদ করলেন, যেন ‘রাজনৈতিক’ হওয়াটা মস্ত দোষের ব্যাপার। কেন রাজনীতির প্রতি এই অনীহা?

শ্রীমন্তী রায়
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:১৮
Share: Save:

গত মাসদুয়েকে বার বার একটা প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের সমাজ— জুনিয়র চিকিৎসকরা যে আন্দোলন করছেন, তা কি চরিত্রে রাজনৈতিক? প্রশ্নটি শুনেই অনেকে এমন ভাবে প্রতিবাদ করলেন, যেন ‘রাজনৈতিক’ হওয়াটা মস্ত দোষের ব্যাপার। কেন রাজনীতির প্রতি এই অনীহা? রাজনীতিকে কি সত্যিই দূরে সরিয়ে রাখা যায়?

রাজনীতির কেতাবি সংজ্ঞা বলবে, এটা অনুশাসনের একটি শৈলী, এবং সবাইকে সংগঠিত করার কাজ। তার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতায় আসা— কিন্তু সেই ক্ষমতা তার নিজের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্ষমতার প্রয়োজন সবাইকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য। ক্ষমতার লড়াইটাই যদি মুখ্য হয়ে ওঠে, তা হলে খর্ব হয় সমাজকে সংগঠিত করার, সবার সহযোগিতায় সমাজকে একটি সদর্থক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যটি। আবার এটাও ঠিক যে, ক্ষমতার লড়াইকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য একটি কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে নাগরিকদের সম্পদ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতাকে একটি যথার্থ মানে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।

অর্থাৎ ‘রাজনীতি’ আসলে এক বিমূর্ত পন্থা, যার মাধ্যমে নাগরিক সামগ্রিক ভাবে উন্নয়নের কথা ভাবে বা চিন্তা করে— এই যে উন্নয়নের ধারণা, তা সর্বজনীন মঙ্গলের ধারণা, অর্থাৎ সকলের ভাল হয়, সেই বোধ। এই চিন্তা আসে মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ থেকে, যার থেকে ‘ন্যায়’-এর ধারণা জন্ম নেয়। এটা ঠিক যে, সমাজে মানুষের ব্যক্তিচিন্তা ও সমষ্টিগত চিন্তা সব সময় এক হয় না। নৈতিক মূল্যবোধও এক-এক জনের এক-এক রকম। কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল্যবোধের সাধারণীকরণ করা সম্ভব— যখন ব্যক্তির মূল্যবোধ সমষ্টিগত মূল্যবোধের সমার্থক বা একাত্মীভূত হয়ে যায়, অর্থাৎ যা অন্যায় তা যে সব পরিস্থিতিতেই অন্যায়, এই বোধ জন্ম নেয়। যে কোনও ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠার পিছনে এই সামাজিক ন্যায়ের ধারণার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন বা মধ্যযুগে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চাইতে রাজার কাছে যেত। সেই সময় তাদের গড়ে ওঠা মূল্যবোধ বা বিশ্বাস এটাই ছিল যে, যা ন্যায্য, রাজা তা-ই করবেন; এবং এর ফলে সামগ্রিক ভাবে ভাল হবে। যুগে যুগে এই রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়েছে, রূপ পরিবর্তিত হয়েছে— কিন্তু রাজনীতি যে সমগ্রতার কথা বলে, তার পরিবর্তন হয়নি। তাই খুব খারাপ সরকার বা শাসকও ‘জনগণের স্বার্থে’— এই শব্দবন্ধ বার বার ব্যবহার করে থাকে।

সমস্যা হল, আমাদের অধিকাংশের কাছেই বর্তমানে রাজনীতি শব্দটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে নির্বাচনের সঙ্গে। রাজনীতির পরিসর যে শুধু ভোটদানের মধ্যে, অথবা দলীয় আনুগত্যের পরিধিতেই সীমাবদ্ধ নয়— তা আমরা ভুলেই গিয়েছি। রাজনীতিক মানেই স্বার্থলোভী, ক্ষমতাপ্রিয়, দুর্নীতিগ্রস্ত একটা অবয়ব ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে, রাজনীতি একটি নেতিবাচক শব্দ, নেতিবাচক বিষয়— ফলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সব কিছুই নেতিবাচক। আমরা ভুলে গিয়েছি যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যেমন রাজনৈতিক স্বার্থ থাকবে, ঠিক তেমনই বিরোধী রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আসার রাজনৈতিক স্বার্থ থাকবে। গণতন্ত্রের সেটাই দস্তুর। অন্যায় তখনই, যখন এই রাজনৈতিক স্বার্থগুলি শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে রূপান্তরিত হয় এবং জনগণের সামগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠে।

রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত থাকে গণপরিসরের ধারণা, যেখানে লোকের মধ্যে ‘যোগাযোগ, সংলাপ ও কথোপকথন’-এর মাধ্যমে ব্যক্তিচেতনার সঙ্গে সমষ্টিগত চেতনার পরিচয় ঘটে। যেখানে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধের দ্বারা, অপশব্দের প্রয়োগ না ঘটিয়ে, ব্যক্তি-আক্রমণ না করে, আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক চেতনার পরিসর বৃদ্ধি পেত, সেই গণপরিসর ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে। সে ক্ষতি আমরা মেনে নিয়েছি বিনা প্রশ্নে, নির্দ্বিধায়। তার জন্য এক দিকে যদি দায়ী হয় আমাদের চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার বোধ, অন্য দিকে দায়ী আমাদের স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা— যত ক্ষণ না নিজের গায়ে আঁচ লাগে, তত ক্ষণ নির্বিকার থাকার সিদ্ধি।

আজ বারে বারেই গণ-আন্দোলনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। তাকে কি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা সম্ভব? প্রত্যেকটা আন্দোলনের আলাদা পরিপ্রেক্ষিত থাকে, আলাদা দাবি থাকে— সেই দাবি কি শুধু সামাজিক ন্যায়বোধ থেকে উঠে আসা সামাজিক দাবি, না কি তার সঙ্গে জড়িত থাকে সুপ্ত রাজনৈতিক চেতনার সেই অংশ, যা রাজনীতির ‘নীতি’কে মান্যতা দেয়? গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকাটাই কাম্য। আমরা যদি রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে না থাকি, যদি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ও রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করি, যদি বুঝে নিতে চাই তাদের অভিপ্রায়, সেই সচেতনতাই সুশাসনের পথ নিশ্চিত করতে পারে। মনে রাখা ভাল, রাজনীতিতে আমার আগ্রহ থাক বা না-ই থাক, রাজনীতির কিন্তু আমার প্রতি আগ্রহ আছে। এবং, আমার অসচেতন অনাগ্রহ রাজনীতির সেই আগ্রহকে ক্রমে বিপজ্জনক করে তুলবেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE