Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সুযোগ ছিল, নষ্ট করলেন

স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, কর্মসংস্থান, চাহিদা: কিছুতেই নজর নেই

সংগঠিত ক্ষেত্রেও অনেকে রাতারাতি কর্মহীন হলেন। এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর একটাই পথ ছিল: শ্রমজীবীদের আয় বাড়িয়ে সরকার সার্বিক চাহিদা ফিরিয়ে আনবে।  

বিশ্বজিৎ ধর
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:২০
Share: Save:

নিজের তৃতীয় বাজেটটি পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এই বারই তাঁর পরীক্ষাটি কঠিনতম ছিল, সন্দেহ নেই— ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সামনে তিনটি দুর্লঙ্ঘ্য চ্যালেঞ্জ ছিল এই বার। সাম্প্রতিক অতীতে কোনও বড় অর্থব্যবস্থাকে এক সঙ্গে এতগুলি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রথমত, অতিমারির ধাক্কায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত; দ্বিতীয়ত, সীমান্তে চিনের সঙ্গে সংঘাত চলছেই; তৃতীয়ত, ভারতে অতিমারি হানা দেওয়ার আগে থেকেই আর্থিক বিপর্যয় শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর্থিক সমীক্ষায় ও বাজেট-ভাষণে বারে বারেই অতিমারিজনিত সমস্যার কথা এসেছে। কিন্তু, ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে প্রায় আট শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধির পর থেকেই যে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ধুঁকতে আরম্ভ করেছে, এই কথাটা তাঁরা স্বীকার করেননি। ঘটনা হল, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক, অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাস থেকে তার পরবর্তী প্রতিটি ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ কোভিড হানা দেওয়ার ঠিক আগে, আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.১ শতাংশ।

সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছিল অর্থব্যবস্থায় মোট চাহিদার ঘাটতি। বেকারত্ব যত বেড়েছে, শ্রমশক্তিতে মানুষের যোগদানের হার যত কমেছে, চাহিদাও ততই কমেছে। অতিমারির ফলে বেকারত্বের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করল। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারালেন। সংগঠিত ক্ষেত্রেও অনেকে রাতারাতি কর্মহীন হলেন। এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর একটাই পথ ছিল: শ্রমজীবীদের আয় বাড়িয়ে সরকার সার্বিক চাহিদা ফিরিয়ে আনবে।

নষ্ট করার মতো সময় সরকারের হাতে ছিল না। এই বাজেটে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, সরকার সময় নষ্ট করেনি। মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা বা একশো দিনের কাজ প্রকল্পে গত বছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬১,৫০০ কোটি টাকা, পরিস্থিতি বুঝে সরকার খরচ করেছিল মোট ১,১১,৫০০ কোটি টাকা। বরাদ্দের চেয়ে ৭২ শতাংশ বেশি। কিন্তু, এই বাজেটে নির্মলা একশো দিনের কাজ প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে ৭৩,০০০ কোটি টাকা করেছেন। অর্থাৎ, গত বছর প্রকৃত যত টাকা ব্যয় করা হয়েছিল বলে হিসেব মিলছে, এ-বছরের বরাদ্দ তা থেকে এক-তৃতীয়াংশ কম। স্পষ্টতই, সরকার মনে করে না যে, দেশে যে সমস্যা চলছে, সেটা কাঠামোগত; এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের ত্রাণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা প্রয়োজন। এবং, এখন যে আর্থিক মন্দা চলছে, তার থেকে নিস্তার পেতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিমাণ বাড়াতে হবে, সরকার এই কথাটাও বিশ্বাস করে না।

অর্থমন্ত্রী পরিকাঠামোর উন্নতির দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন। এই অবস্থানকে স্বাগত না জানানোর কোনও কারণ নেই। দীর্ঘ দিন ধরেই দেশ পরিকাঠামোর অভাবে ভুগছে। বিনিয়োগকারীরাও এই সমস্যার কারণে যথেষ্ট লগ্নি করেন না। অর্থব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে হলে পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাতেই হবে। সীতারামন যে ঘোষণাগুলি করলেন তা ২০১৯-এ ঘোষিত ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন প্রকল্পের অন্তর্গত; ২০২০’তে যে আর্থিক পুনরুত্থান প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, তাতেও এই প্রকল্পগুলি ছিল। ২০১৯-এ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়াল অন্তর্বর্তী বাজেট-ভাষণে যা বলেছিলেন, বর্তমান ঘোষণা তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। আজকের ঘোষণার প্রেক্ষিতে দুটো প্রশ্ন অনিবার্য। এক, ২০২০-২১ সালের বাজেটে সরকার পরিকাঠামো খাতে যে লগ্নির কথা ঘোষণা করেছিল, এই বাজেটে তার উপর কতটা বৃদ্ধি হল? দুই, এই প্রকল্পগুলি কবে শেষ হবে, তার কোনও মেয়াদ নির্ধারিত হয়েছে কি?

দেশের গ্রামাঞ্চল পরিকাঠামোর অভাবে ভুগেছে সবচেয়ে বেশি। ভারতের কৃষিক্ষেত্র যে কিছুতেই লাভজনক হয়ে উঠতে পারে না, তার একটা প্রধান কারণ এই পরিকাঠামোর অভাব। বাজেটে অর্থমন্ত্রী যে পরিকাঠামো নির্মাণের কথা বলেছেন, সেই পরিকল্পনায় গ্রামীণ ভারত নেই। অথচ গ্রামীণ পরিকাঠামোকে অগ্রাধিকার দিলে দেশের ৬০ শতাংশ শ্রমশক্তি লাভবান হত। সে কথা না ভেবে অর্থব্যবস্থাকে বৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে আনার একটা বড় সুযোগ অর্থমন্ত্রী হারালেন। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে শেষ অবধি যত টাকা খরচ হল, এই বছর অন্তত তত টাকা বরাদ্দ করা উচিত ছিল— ১,১১,৫০০ কোটি টাকা, এবং তার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধিজনিত বাড়তি টাকা। এই টাকাটা খরচ করলে যাঁরা কাজের অভাবে ধুঁকছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান হত, এবং পাশাপাশি গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নয়নও নিশ্চিত করা যেত।

চলতি আর্থিক মন্দায় গোটা দুনিয়া জুড়েই অপুষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। ভারতেও। এই দেশে এখন বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের বাস। চলতি অর্থবর্ষের বাজেটে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন বাবদ বরাদ্দ হয়েছিল ৭৮,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু, প্রয়োজন বুঝে সরকার এই খাতে ৩,৪৪,০০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী খাদ্য সুরক্ষা আইন বাবদ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে ২,০০,০০০ কোটি টাকার সামান্য বেশি করলেন। দেশে অপুষ্টি ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়ার একটা মস্ত ব্যবস্থা সরকারের হাতে ছিল— গণবণ্টন ব্যবস্থার পরিধি বিস্তার করে সব অপুষ্ট মানুষের কাছে অন্ন পৌঁছে দেওয়া যেত। বিশেষত, সরকার যখন ধান ও চাল কিনতে ২,৫০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, তখন বণ্টন করার মতো খাদ্যের সংস্থান ছিলই। কিন্তু, খাদ্য সুরক্ষা আইনের খাতে বরাদ্দ কমানোয় এই ক্ষেত্রে একটি মস্ত প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল।

গত মাসে ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম টিকাকরণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পটিকে সফল করতে হলে সবার কাছে যেমন যথাসম্ভব কম সময়ে টিকা পৌঁছে দিতে হবে, তেমনই টিকাকে সবার আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও রাখতে হবে। অর্থাৎ, এই কর্মসূচির সাফল্যের পূর্বশর্ত হল, দেশে একটা মজবুত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ দিকে, দশকের পর দশক ধরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অবহেলিত হয়ে এসেছে। কোভিড-অতিমারি দুনিয়ায় সব দেশকেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়েছে। বহু দেশই মন দিয়েছে এই পরিকাঠামো নির্মাণে, তার ফাঁকফোকর মেরামতের কাজে— মূলত সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে। কাজেই, ভারত এই বিষয়ে কী করে, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল। কিন্তু, বাজেটে যে ছবিটা পাওয়া যাচ্ছে, তা হতাশাজনক। এই অর্থবর্ষে স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ৭৯,০০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে অনুমান— আর, এই বাজেটে ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জন্য নির্মলা বরাদ্দ করলেন ৭১,০০০ কোটি টাকা। কাজেই প্রশ্ন উঠছে, সবার কাছে কোভিডের টিকা পৌঁছে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব হবে?

রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের নীতির ক্ষেত্রে সরকার কী অবস্থান নেয়, এই বাজেটে সেটা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার মনে করিয়ে দিয়েছে, জি-২০ গোষ্ঠীর দেশগুলির মধ্যে ভারতেই সরকার সবচেয়ে কম ব্যয় করেছে। সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অতি রক্ষণশীল অর্থ ভান্ডারও এই ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলছে। অন্য দিকে, অর্থ ভান্ডার বারে বারেই মনে করিয়ে দিয়েছে যে, বিশেষত ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের পর থেকেই উন্নত দেশগুলিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ক্রমশ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই পরামর্শের বিপরীতে হেঁটে ভারতের সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের বেগ বাড়িয়েই চলেছে। এই বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থমন্ত্রী জানালেন, লাইফ ইনশিয়োর‌্যান্স কর্পোরেশনে সরকারের যে ভাগ আছে, তার বিলগ্নিকরণ হবে।

অনিবার্য প্রশ্ন হল, রাজস্ব আদায়ের অন্য সব পথই কি সরকার যাচাই করে দেখেছে? এই প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক। কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বিপুল কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে যে, এই ছাড় দিয়ে অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সুবিধা হয়নি। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি এক অর্থে পারিবারিক সম্পদের মতো। তা বেচে যেমন সংসার চালানো যায় না, তেমনই সেই বিক্রির টাকায় দীর্ঘ দিন ধরে দেশও চালানো যায় না।

অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE