E-Paper

মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, এবং...

ছবিটির প্রথম ‘টিজ়ার’-এ বলা হয়েছিল— ‘কেরলের ৩২০০০ মহিলার হৃদয়বিদারক কাহিনি’। মামলার ধাক্কায় পরে নির্মাতারা টিজ়ার থেকে ৩২০০০ সংখ্যাটি সরিয়ে দেন।

সীমন্তিনী গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৩ ০৪:৩৯
The Kerala Story.

সুদীপ্ত সেনের ছবি দ্য কেরালা স্টোরি। —ফাইল চিত্র।

ইসলামিক স্টেট বা আইএস নামক জঙ্গি সংগঠনটি বিভিন্ন দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদী ‘সংগ্রহ’ করে থাকে। এমনকি ভারত থেকেও। ২০২০ সালে তথ্যের অধিকার আইনে করা একটি মামলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দাখিল করে জানিয়েছিল যে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১৭৭ জন ভারতীয়কে তারা গ্রেফতার করেছে, যাদের সঙ্গে আইএস-এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ রয়েছে। এদের মধ্যে তামিলনাড়ুর বাসিন্দা ৩৪ জন, মহারাষ্ট্রের ২৬ জন, উত্তরপ্রদেশের ২৫ জন, কেরলের ১৯ জন এবং তেলঙ্গানার ১৭ জন। জনা পঞ্চাশেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির অনুমান, ১৮০ থেকে ২০০ জন ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তান ও সেখান থেকে সিরিয়া গিয়ে আইএস-এ যোগদান করেছে। তাদের মধ্যে জনা চল্লিশেক কেরলের বাসিন্দা। ফলে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগ রয়েছে, এমন ভারতীয়ের মোট সংখ্যা— কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুয়ায়ী— ৩৫০ থেকে ৪০০। তাদের মধ্যে মোটামুটি অর্ধেক, অর্থাৎ ১৭৫-২০০ জন, মহিলা।

যে সব ভারতীয় মহিলা ইসলামিক স্টেটে নাম লেখাতে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে সুদূর আফগানিস্তান, সিরিয়া বা পশ্চিম এশিয়ার অন্য কোনও দেশে পাড়ি দিয়েছে, তাদের নিয়েই সুদীপ্ত সেনের ছবি দ্য কেরালা স্টোরি। ছবিটিতে ধর্মান্তরিত ও আইএস-এ যোগদান করা মহিলাদের যে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের দাখিল করা পরিসংখ্যানের থেকে অনেক, অনেক বেশি। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কেরল থেকে ২১ জন ‘নিখোঁজ’ হয়। আসলে ‘নিখোঁজ’ নয়, এরা সবাই সীমান্ত পেরিয়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছিল। এদের মধ্যে ছ’জন মহিলা এবং ১৫ জন পুরুষ; ১৬ জন ছিল কাসারগড়, তিন জন পল্লাকড়, এক জন করে তিরুঅনন্তপুরম ও এর্নাকুলামের বাসিন্দা; ১৭ জন মুসলিম, তিন জন খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং এক জন হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম। এনআইএ-র তথ্য অনুযায়ী, যে লোকটি এই ২১ জনকে কেরল থেকে ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে নিয়ে গিয়েছিল, তার নাম আব্দুল রশিদ। বয়স ২৯। পেশায় স্কুলশিক্ষক।

ছবিটির প্রথম ‘টিজ়ার’-এ বলা হয়েছিল— ‘কেরলের ৩২০০০ মহিলার হৃদয়বিদারক কাহিনি’। মামলার ধাক্কায় পরে নির্মাতারা টিজ়ার থেকে ৩২০০০ সংখ্যাটি সরিয়ে দেন। কিন্তু, এই ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আরও নানা সন্দেহজনক পরিসংখ্যান। যেমন একটি দৃশ্যে নিমা নামের চরিত্রটি এক পুলিশ অফিসারকে বলে, “লাভ জেহাদের শিকার হয়ে নিখোঁজ, কেরলের এমন ৩০ হাজার মেয়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি। আমাদের অনুমান, সংখ্যাটি ৫০ হাজারের কাছাকাছি।” ৩০ হাজার? ৫০ হাজার? সরকারি তথ্য কি ছবির এই পরিসংখ্যানকে মান্যতা দিচ্ছে?

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে, কেরল থেকে সে বছর নিখোঁজের সংখ্যা ১০,৯৯৬। মনে রাখার, কেন্দ্রীয় সংস্থা বলেনি যে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা সবাই জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে। যত জন নিখোঁজ হয়, তাদের মধ্যে অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায়, কেউ কেউ ফিরে আসে স্বেচ্ছায়। যেমন, ২০২০ সালে কেরল থেকে যে হাজার দশেক মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল, তাদের মধ্যে ন’হাজারই ফিরে এসেছিল ২০২১-এ রিপোর্ট প্রকাশের আগে। খোঁজ পাওয়া যায়নি হাজার খানেকের। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ‘টোটাল মিসিং অ্যান্ড ট্রেসড পার্সনস (স্টেট অ্যান্ড ইউনিয়ন টেরিটরিজ়) ২০২১’ নামের এই রিপোর্টটি থেকে। দেখা যাচ্ছে, কেরলের থেকে অনেক বেশি নিখোঁজের সংখ্যা মধ্যপ্রদেশ (৯১,২৯৯) ও মহারাষ্ট্র (১,০৯,৫৮৫), এই দুই রাজ্যে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেরল থেকে ‘হারিয়ে যাওয়া’ মানুষের সংখ্যা যখন মেরেকেটে হাজারখানেক, সেখানে ত্রিশ বা পঞ্চাশ হাজার মহিলা জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে— এই সংখ্যাগুলি কোথা থেকে পেলেন ছবির নির্মাতারা? দেশের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থাগুলির চোখ এড়িয়ে এত মহিলার পক্ষে কি সীমান্ত পেরিয়ে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া সম্ভব?

ছবিতে বার বার দাবি করা হয়েছে যে, কেরলের ৩২ হাজার মহিলা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এ বিষয়ে একমাত্র সরকারি পরিসংখ্যান বলতে কেরলের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডির একটি বক্তব্য। ২০১২ সালে তিনি কেরল বিধানসভায় জানিয়েছিলেন, ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ২৬৮৭ জন মহিলা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। অর্থাৎ, গড়ে বছরে ৪৫০। চান্ডি এ-ও জানিয়েছিলেন যে, এদের মধ্যে কোনও মহিলাকেই জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়নি। সে সময়ের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছিল, ২০২০ সালে কেরলে ১৪৪ জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, আর ২৪১ জন হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।

ত্রিশ হাজারের বদলে যদি তিন জন তরুণীও ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি হয়ে যায়, সেটা কি যথেষ্ট উদ্বেগজনক নয়? হ্যাঁ, অবশ্যই। কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা উচিত নয়, কারও মগজধোলাই করে সন্ত্রাসে দীক্ষিত করা অপরাধ। কিন্তু, কিছু মনগড়া সংখ্যা ব্যবহার করে কোনও রাজ্যের ‘বাস্তব’ প্রদর্শনের অপচেষ্টাটি নিন্দনীয়। এ ছাড়া, খুব সচেতন ভাবে, ছবির নির্মাতারা দু’শ্রেণির ধর্মান্তরিত মহিলার মধ্যে পার্থক্যও মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক দলে রয়েছে মৌলবাদে উদ্বুদ্ধ, জঙ্গি দলে নাম লেখাতে চাওয়া, স্বামীর সঙ্গে আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় পাড়ি দেওয়া মহিলারা। সংখ্যায় হাতে গোনা হলেও তাদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা যায় না। অন্য দিকে, রয়েছে সেই সব ধর্মান্তরিত মহিলা, যাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনও সংযোগ নেই। তারা ভালবেসে বিয়ে করেছে এবং স্বেচ্ছায় স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারা ‘অপরাধী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ নয়, কারণ ভারতীয় সংবিধান দেশের প্রতিটি মানুষকে নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে।

ভ্রান্ত পরিসংখ্যানের খপ্পরে পড়ে দ্য কেরালা স্টোরি-র নির্মাতারা ভারতীয় সংবিধানের এই জরুরি কথাগুলিই ভুলে গেলেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

The Kerala Story Bollywood movie controversy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy