E-Paper

বেয়াড়া প্রশ্ন যাতে না করেন

তাই দীর্ঘ দশ বছর জেলের প্রায়ান্ধকার কুঠুরির মধ্যে নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিলেন গোকারাকোন্ডা নাগা সাইবাবা। ভাবতেও পারেননি, জীবিত অবস্থায় তিনি মুক্তি পাবেন!

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৮:৩৩
Gokarakonda Naga Saibaba

— ফাইল চিত্র।

মানুষটি হুইলচেয়ারে আশ্রয় নিয়েছেন, ৯০ শতাংশেরও বেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তেমন এক প্রৌ‌ঢ়কে কারাবন্দি করে রাখতে বদ্ধপরিকর এক রাষ্ট্র। কোনও অবস্থায় তাঁকে জেলের বাইরে দেখতে চান না মহা পরাক্রমশালী নেতারা। বাইরে এলেই যদি বেয়াড়া প্রশ্ন করেন, সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের সুরক্ষা নিয়ে কথা তুলে রাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত করেন? ভারতই গোটা বিশ্বের চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে, এই মনোহর প্রচারের অন্তরালের বাস্তবকে যদি খুঁচিয়ে বার করতে চান?

তাই দীর্ঘ দশ বছর জেলের প্রায়ান্ধকার কুঠুরির মধ্যে নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিলেন গোকারাকোন্ডা নাগা সাইবাবা। ভাবতেও পারেননি, জীবিত অবস্থায় তিনি মুক্তি পাবেন! নাগপুর সেন্ট্রাল জেলের কুখ্যাত ‘আন্ডা সেল’-এ বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষটির শরীরে বহু রোগ বাসা বেঁধে রয়েছে। চিকিৎসার জন্য বার বার আর্জি জানিয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন অধ্যাপক। তাঁর অবস্থা দেখে অশীতিপর জেসুইট ফাদার স্ট্যান স্বামীর কথা মনে পড়ে। যথাযথ চিকিৎসা ও জামিনে মুক্তির জন্য অসংখ্য বার কাতর আর্জি জানাতে জানাতে জেলবন্দি অবস্থাতেই মৃত্যু হয় স্ট্যান স্বামীর।

জেল থেকে বেরিয়ে সাইবাবা বলেছেন, “আমার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। চিকিৎসা না করিয়ে কথা বলতে পারব না। শিক্ষক হিসাবে আমি আমার কর্মজীবনের শীর্ষ পর্বে ছিলাম। পড়ুয়াদের কাছ থেকে টেনে এনে আমাকে দশ বছর জেলে অমানবিক জীবনের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল। নিজে চলাফেরা করতে পারি না। সাহায্য ছাড়া শৌচাগারে বা স্নান করতে যেতে পারতাম না। কোনও ক্রমে জীবিত মুক্তি পেয়েছি।”

কিন্তু এখানে প্রশ্নটা নিছক এক জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জেলবন্দি মানুষের চিকিৎসার নয়, প্রশ্নটা হল, যে ভাবে অধ্যাপক, সাংবাদিক, অধিকার কর্মীদের ইউএপিএ প্রয়োগ করে জেলে পোরা হল, তা কি নিয়ম মেনে করা হচ্ছে? জি এন সাইবাবার মামলায় বম্বে হাই কোর্টের রায় বলছে, তা হয়নি। কারণ, ইউএপিএ দিতে হলে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের এক বিশেষ কমিটির অনুমোদন লাগে। সেই অনুমোদন আসার আগেই ট্রায়াল কোর্টে সাইবাবাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। ইতিপূর্বে এই কোর্টেরই আর একটি বেঞ্চ ২০২২ সালে সাইবাবা ও অন্যদের মুক্তি দেয়, মামলাটির পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য। কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ আনে মহারাষ্ট্র সরকার।

মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় উস্কানি দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে অধ্যাপক জি এন সাইবাবাকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৪-র মে মাসে। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করা হয়। ২০১৭-য় মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি জেলার নিম্ন আদালত সাইবাবার সঙ্গেই সাংবাদিক প্রশান্ত রাহি, মহেশ টিকরি, হেম কেশদত্ত মিশ্র এবং পাণ্ডু নারোতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। ১০ বছরের জেল হয় বিজয় নান টিকরির। এর মধ্যে পাণ্ডু নারোতে জেলেই মারা যান।

৫ মার্চ, ২০২৪ বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চের বিচারপতি বিনয় জি জোশী এবং বিচারপতি বাল্মীকি এস মেনেজেস সাইবাবার মুক্তির নির্দেশ দেন। তাঁর সঙ্গেই ছাড়া পান প্রশান্ত, মহেশ, হেম ও বিজয়। এই রায়ের পরেও সুপ্রিম কোর্টে স্পেশাল লিভ পিটিশন দাখিল করে মহারাষ্ট্র সরকার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি আর গাভাই এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতা মন্তব্য করেন, সাইবাবার মুক্তির নির্দেশ ‘বহু পরিশ্রমে পাওয়া’। বম্বে হাই কোর্টের রায় ‘অত্যন্ত সুচিন্তিত’। বিচারপতিরা প্রশ্ন তোলেন, সাইবাবার মতো এক জন মানুষকে কেন অকারণে ১০ বছর কারাবাস করতে হল? সাইবাবা ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগই আদালতে প্রমাণিত হয়নি।

তা হলে সাইবাবার হারানো দশ বছর কে ফিরিয়ে দেবে? ২০২১ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তাঁর স্ত্রী বসন্ত কুমারী ও তাঁদের কন্যাসন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়। সাইবাবার মুক্তির পরে দাবি উঠছে, তা হলে তাঁর অধ্যাপনার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। দেওয়া হোক ক্ষতিপূরণ।

সাইবাবার মতো রাজনৈতিক বা মানবাধিকার কর্মী, কিংবা বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের উপরে আইনের বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করে বছরের পর বছর জেলের কুঠুরিতে আটকে রাখা হয়, তখন তাঁদের হয়ে সরব হয় ক’টি রাজনৈতিক দল? বিক্ষুব্ধ স্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য নির্বিচারে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহী বা মাওবাদী তকমা। সর্বত্র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে রাষ্ট্র! জেল থেকে লেখা তাঁর সাম্প্রতিক কবিতা ও চিঠির বই হোয়াই ডু ইউ ফিয়ার মাই ওয়ে সো মাচ-এ সাইবাবা লিখছেন, “আমি এখনও একগুঁয়ের মতো প্রত্যাখ্যান করি মৃত্যুকে/ দুঃখের বিষয়, ওরা জানে না আমাকে কী ভাবে মারতে হবে।”

কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্র তা না জানতে পারে, কিন্তু ‘আমিত্ব’-সর্বস্ব বলদর্পী রাষ্ট্রশক্তি জানে, কী ভাবে প্রতিস্পর্ধাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়! তবে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সাইবাবারা মগ্ন থাকবেন রুদ্ধকণ্ঠ মানুষের হয়ে রাষ্ট্রের সামনে কথা বলতে। প্রান্তিক মানুষের ভাষাকে আরও অসংখ্য মানুষের ভাষায় পরিণত করার কাজে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Jail

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy