Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Mental Health

পুনর্বাসনের দীর্ঘ পথ

প্রেস বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে, মানসিক হাসপাতালে সুস্থ হয়ে-ওঠা মনোরোগীদের বেআইনি ভাবে হাসপাতালে আটকে রেখে তাঁদের স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

Representational image of Mental disorder.

সুস্থ মনোরোগীদের জন্য একটি আবাসন তৈরি হয়েছে এই রাজ্যে। প্রতীকী ছবি।

রত্নাবলী রায়
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৪৯
Share: Save:

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেশের মানসিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্তদের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রেস বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে, মানসিক হাসপাতালে সুস্থ হয়ে-ওঠা মনোরোগীদের বেআইনি ভাবে হাসপাতালে আটকে রেখে তাঁদের স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

বিষয়টি আলোচনা দাবি করে। সুস্থ মনোরোগীদের জন্য একটি আবাসন তৈরি হয়েছে এই রাজ্যে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই জীবন সহায়তা প্রকল্প পরিচালনা করছে, এবং আবাসিকদের সামাজিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করছে। এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে সুস্থ মনোরোগীদের সামাজিক পুনর্বাসন বিষয়ে কয়েকটি কথা মনে হয়েছে। আমরা যাকে বলি ‘সুস্থ’, চিকিৎসার পরিভাষায় তা হল ‘ফিট ফর ডিসচার্জ’। তার মানে, যাঁর আর হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই। তা বলে এঁরা সকলেই কর্মক্ষম, সম্পূর্ণ স্বনির্ভর, এমন নয়। কেউ কাজে যোগ দিতে পারেন, আবার অনেকের হয়তো বাড়িতে সর্বক্ষণের সহায়তা লাগবে। এই সাহায্যকারী কাঠামোটা পরিবার হতে পারে, না-ও পারে। বাড়িতে শুধুই বৃদ্ধ, অসুস্থ, অশক্ত বাবা/মা থাকতে পারেন। এক ব্যক্তির মানসিক রোগের চিকিৎসা চলাকালীন তাঁর স্বামী বা স্ত্রী সন্তান-সহ নতুন করে সংসার করছেন, এমনটাও সম্ভব। অনেক সময়ে প্রতিবেশীরাই সেই ব্যক্তিকে না ফেরানোর জন্য পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। অনেক ক্ষেত্রে সম্পত্তির লোভে ঘনিষ্ঠরাই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছেন। আবার কারও হয়তো পরিবার নেই, কেবল ফিরে যাওয়ার একটা ঠিকানা আছে, যা আত্মীয়-প্রতিবেশীদের হেফাজতে ছিল। সে ক্ষেত্রে ‘ফিট ফর ডিসচার্জ’ মানুষটির সুস্থতার প্রমাণ চাইতে পারেন এই আত্মীয়-প্রতিবেশীরা। হাসপাতাল-ফেরত সহায়-সম্বলহীন মানুষটিকে হয়তো তৈরি হতে হবে নিজের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার জন্য।

‘ফিট ফর ডিসচার্জ’ ব্যক্তি যখন কর্মক্ষম, নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দায়িত্ব নিজে নিতে পারেন, কিন্তু পরিবার অনুকূল নয়, তখন তাঁর দু’ভাবে সহায়তা করা যায়। পরিবার, প্রতিবেশীকে বুঝিয়ে, পরামর্শ ও আশ্বাস দিয়ে পরিবারের সদস্যকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। যখন তা সম্ভব নয়, তখন তাঁদের জন্য তৈরি করা যায় আবাসিক কেন্দ্র। এ রাজ্যে নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর এই হোমের দায়িত্ব নিয়েছে। এখানে পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা একটি অনুকূল, আনন্দময় পরিবেশ পান। কিন্তু ‘ফিট ফর ডিসচার্জ’ হওয়া সত্ত্বেও যাঁরা নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারেন না, কর্মক্ষমও নন, এমন মানুষদের কোনও আশ্রয়কেন্দ্র এখনও তৈরি হয়নি। তার জন্য পরিচর্যার পরিকাঠামো দরকার।

যাঁরা কর্মক্ষম কিন্তু পরিবার-বিচ্ছিন্ন, তাঁদের জন্য কাজের জোগাড় করতে গিয়ে সমস্যা হয় এঁদের নাগরিক পরিচিতি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অভাব। এঁদের অধিকাংশের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড নেই, অথবা তা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার কর্মীদের অনেকেই সকলের জন্য নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু এই মানুষগুলোর নাগরিক পরিচয়ের দাবি, কখনওই সেই আন্দোলনের মূল দাবি-সনদে জায়গা করে নিতে পারেনি। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই মানুষগুলোর ভোটাধিকার আদায় করা গিয়েছে। কিন্তু প্রায়োগিক ভাবে সকলের ভোটার কার্ড নেই। এই মানুষগুলোর ভোটের সংখ্যা যে-হেতু বেশি নয়, তাই রাজনৈতিক দল আর অধিকার আন্দোলন, দু’পক্ষই অমনোযোগী থাকতে পেরেছে।

আজ যখন ‘ফিট ফর ডিসচার্জ’ এবং কর্মক্ষম ব্যক্তিদের সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য কর্মসংস্থানের চেষ্টার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন কোথাও এই প্রশ্নটা উঠছে না যে, সরকারের আবাস যোজনা, কর্মসংস্থান প্রকল্প বা সামাজিক সহায়তা প্রকল্পে কেন এঁদের অধিকার থাকবে না?

কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার বাধা আসতে পারে ব্যক্তির দিক থেকেও। নিয়ন্ত্রিত, আগলে-রাখার পরিবেশে যিনি দীর্ঘ দিন বাস করেছেন, তিনি কর্মক্ষম হলেও কাজ করার অভ্যাস হারিয়েছেন দীর্ঘ দিন। স্বনির্ভর জীবনের প্রতি তাঁর আগ্রহ ফিরলে তবেই কাজ করা জরুরি মনে হবে। স্বনির্ভরতার প্রতি তাঁর মনোভাব কিন্তু ‘ফিট ফর ডিসচার্জ’-এর ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞার মধ্যে আসে না। আবার স্বনির্ভরতার ইচ্ছা কারও মধ্যে এত তীব্র হতে পারে যে, তিনি নিয়ন্ত্রিত জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে জীবন সহায়তা কেন্দ্র থেকে নিজেই বেরিয়ে যেতে পারেন। কাজ না করা, অথবা কাজ করতে চেয়ে সহায়তা কেন্দ্র প্রত্যাখ্যান করা, এ দুটোই রোগীর অধিকারের মধ্যে পড়ে।

তাই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন হল না, এ প্রশ্ন তোলা এক দিকে যেমন জরুরি, অন্য দিকে তেমনই সতর্কও হতে হবে। যে মানুষগুলোর অধিকার রক্ষার জন্য কমিশন আগ্রহী, সেই মানুষগুলোকে থাকবন্দি করে ফেলে তাঁদের অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে না তো? হাসপাতাল-বন্দি মনোরোগীকে সমাজ-সংসারে পুনরায় স্থাপনের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাতে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অন্য দিকে, অধিকার আন্দোলন সংগঠনগুলি কেন এই মানুষদের অধিকার হরণের প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? এই দুটো প্রশ্নই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mental Health NHRC India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE