Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Swami Vivekanada

‘স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল’

অনন্তের আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে যিনি ধরায় আসেন তিনি কেবল সাধক নন, প্রেমিক পাগলও বটে। প্রেমের করুণাগঙ্গা বইয়ে দেন শ্রীরামকৃষ্ণ, জাগিয়ে তোলেন প্রেমিক বিবেকানন্দকে।

স্বামী বিবেকানন্দ আজীবন ছিলেন নিঃশ্রেয়সের নির্বেদ পূজারি।

স্বামী বিবেকানন্দ আজীবন ছিলেন নিঃশ্রেয়সের নির্বেদ পূজারি। ফাইল ছবি।

স্বামী ঊর্জিতানন্দ
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৮
Share: Save:

ছি ছি, তুই এত বড় আধার, তোর মুখে এই কথা! আমি ভেবেছিলাম, কোথায় তুই একটা বিশাল বটগাছের মতো হবি, তোর ছায়ায় হাজার হাজার লোক আশ্রয় পাবে, তা না হয়ে তুই কিনা শুধু নিজের মুক্তি চাস! এ তো অতি তুচ্ছ হীন কথা!... একাধারে জ্ঞানী ও ভক্ত দুই হ।” শ্রীরামকৃষ্ণ এ ভাবেই তিরস্কার করেছিলেন সমাধি-আনন্দে মগ্ন থাকতে চাওয়া প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে। অরূপ-অসীম যিনি, জীবের প্রতি অতলান্ত প্রেমে তিনিই মানবকায় ধারণ করেছেন যুগে যুগে, রাম-কৃষ্ণ-বুদ্ধ-খ্রিস্ট-মহম্মদ-চৈতন্য রূপে! এই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদা দেবী-স্বামী বিবেকানন্দও একই প্রদীপের তিন অনির্বাণ শিখা। অনন্তের আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে যিনি ধরায় আসেন তিনি কেবল সাধক নন, প্রেমিক পাগলও বটে। জ্ঞানী বিবেকানন্দ, যোগী বিবেকানন্দের হৃদয় থেকে সেই প্রেমের করুণাগঙ্গা বইয়ে দেন শ্রীরামকৃষ্ণ, জাগিয়ে তোলেন প্রেমিক বিবেকানন্দকে।

নিজের ঈশ্বরত্ব উপলব্ধির সমান্তরালে প্রতিটি সত্তায় চৈতন্যের প্রকাশ দর্শন করে মানুষের প্রতি ভালবাসায় ভেসে গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। সেই প্রেম তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে, তবু তা ছিল অনাসক্তিতে জারিত। মানুষের কষ্টে তাঁর হৃদয় দীর্ণ হয়েছে, তবু তিনি ছিলেন প্রশান্তিপথের ঋতপথিক। সমব্যথার কোমলতা তাঁর দু’চোখ ও মন প্লাবিত করেছে, সেই অশ্রুই তাপদগ্ধ মানুষের উপর ঝরেছে আশিস হয়ে।

অভ্যুদয়ের অভিযাত্রী নয়, স্বামী বিবেকানন্দ আজীবন ছিলেন নিঃশ্রেয়সের নির্বেদ পূজারি। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র গ্রাস করেছে সোনার সংসারকে, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, যুবক নরেন্দ্র এমন পরিস্থিতিতেও দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর কাছে বারংবার চেষ্টা করেও নিজের জন্য, পরিবারের জন্য অন্ন-বস্ত্র চাইতে পারেননি, বদলে প্রতি বারই জগন্মাতার সন্মুখে দাঁড়িয়ে চিন্ময়ীর সাক্ষাৎ দর্শনে বিভোর হয়ে চেয়েছেন শুধু জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক ও বৈরাগ্য। বিশ্বচরাচরে সর্বত্র সেই পরমা শক্তির সাক্ষাৎ দর্শন পেতেন বলেই নরেন্দ্রর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে বলেছিলেন ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’র কথা। ভাবীকালে সেই অনন্য বাণীই স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা জগৎসংসারের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। “বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” এ শুধু তাঁর লেখা কবিতার পঙ্‌ক্তিমাত্র নয়, তাঁর জীবনবেদ।

ঈশ্বরপ্রেম ও মানবপ্রেমের ভাগবত অভিসার ঘটেছিল তাঁর হৃদি-বৃন্দাবনে। স্বামীজি চেয়েছিলেন জগতের সকল দুঃখকে নিজ হৃদয়ে মন্থন করে এক উপশমকারী অমৃতসুধা তৈরি করে বিশ্বে বিতরণ করতে, সকলের সকল দুঃখ-বেদনা-ব্যথার বোঝা হাসতে-হাসতে নিজের কাঁধে বহন করতে। প্রতিদান চাননি কিছুই— সকলের দুঃখ দুঃস্বপ্ন ঘুচে যাক, আর তাঁরা ভুলে যাক যে কোনও কালে বিবেকানন্দ বলে কেউ ছিল, এই নিঃস্বার্থ অহেতুক ভালবাসা মূর্ত হয়েছিল তাঁর জীবন ও কাজে।

এক বার নিজের বুকে হাত দিয়ে সজল চোখে গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দ মহারাজকে বলেছিলেন তিনি, “হরিভাই, আমি এখন তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথা বোধ করতে শিখেছি। বিশ্বাস করো, আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে!” সন্ন্যাসী হয়েও তিনি হৃদয় বিসর্জন দেননি, গুরুভ্রাতা বলরাম বসুর মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে শিক্ষা দেয়, আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না।”

তৎকালীন সমাজ ও জীবনের বিভীষিকাময় আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষের দুঃখ-বেদনার প্রসঙ্গ উঠলে, বেদ-বেদান্ত পড়া ছেড়ে সজল নেত্রে কক্ষান্তরে যাওয়া বিবেকানন্দকে লক্ষ্য করে গিরিশচন্দ্র ঘোষ স্বামীজির শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, “কত বড় প্রাণ! তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না; কিন্তু ওই যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্যও মানি! চোখের সামনে দেখলি তো, মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে করুণায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে স্বামীজীর বেদ-বেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল!” প্রেমে বেহিসাবি বিবেকানন্দ ১৮৯৯ সালের কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের কষ্ট দূর করতে অর্থের প্রয়োজনে বেলুড় মঠের জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।

যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের সঙ্গে তাঁর একাত্ববোধ এমন পর্যায়ে উন্নীত হয় যে, সহস্র যোজন দূরের অঘটন-দুর্ঘটনাও তাঁর হৃদয়ে সুতীব্র অভিঘাত আনত। তাঁর ভালবাসায় আগল ছিল না, কম-বেশি বোধও ছিল না, সমদর্শিতা ছিল তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য। খেতড়ির মহারাজা অজিত সিংহ আর রাজসভার নর্তকী, দুই জনই ছিলেন তাঁর কাছে সমান সমাদৃত; বিত্তশালিনী জোসেফিন ম্যাকলাউড যেমন তাঁর মমতার স্পর্শ পেয়েছিলেন, বিদুষী মার্গারেট নোবলও তেমনই তাঁর কল্যাণস্পর্শে হয়ে উঠেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। ‘অহম্‌ ব্রহ্মাস্মি’, ‘তত্ত্বমসি’— উপনিষদের এই মহাবাক্যসমূহ সন্ন্যাসীপ্রবর স্বামী বিবেকানন্দের মানসলোককে অনায়াস অধ্যাত্মবোধে ছেয়ে ছিল, সেই বোধই তাঁর বাহ্যিক জীবনে ধ্বনিত হত। লিখে গিয়েছিলেন— “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,” “ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল।” শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, তিনি ছিলেন “L-O-V-E Personified”। স্বামীজি-রচিত শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তবে পাওয়া যায় ‘চির-উন্মদ প্রেম-পাথার’ এই শব্দবন্ধ। একই কথা বুঝি তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য— পৃথিবীর ইতিহাস জানে, আমরাও জানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekanada Sri Ramakrishna love
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE