—প্রতীকী চিত্র।
বর্তমানে পশ্চিমি বিশ্বে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকের ঘাটতি। ব্রিটেনে ট্রেন-বাসের চালক পাওয়া যাচ্ছে না, রেস্তরাঁতে পরিবেশকের সংখ্যা কমে গিয়েছে, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মী-সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। যে সব কাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ, সেই কাজগুলিতে এই সমস্যা আরও তীব্র। আমেরিকা এবং ইউরোপেও অবস্থা একই রকম। প্রচুর লোক আর কাজ করতে চাইছেন না।
অতিমারির প্রাথমিক স্তরে আমেরিকাতে চাকরির সংখ্যা কমে গিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপে তুলনামূলক ভাবে ততটা কমেনি। এর কারণ, এই দেশগুলির সরকার চাকরিগুলি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা করেছিল। তার একটা বড় অংশ ছিল বিভিন্ন অনুদান দেওয়া— যেমন ব্রিটেনে ফারলো প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। ২০২১-এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জি৭ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির চাকরির অবস্থার অনেকটা উন্নতি হল। যদিও সেই সময়েই ব্রিটেন এবং আমেরিকায় অনেকেই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে শ্রমশক্তি থেকে সরে গেলেন। কাজের বাজার থেকে যত লোক স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেলেন, পাটিগণিতের নিয়ম অনুযায়ী বেকারত্বের হারও ততটাই কমল।
শ্রমের বাজারে কর্মীর জোগান কমলে, অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকের নিয়ম অনুযায়ী, মজুরির হার বাড়ার কথা। কিন্তু, তেমনটা হচ্ছে না— যেমন ট্রেনচালক, বা স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন বাড়ছে না। ব্রিটেনে এই কর্মীরা ধর্মঘটের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। আবার, যে সব কাজে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও কম্পিউটারের প্রয়োগ বেশি, তার প্রভূত চাহিদা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে দক্ষ এবং অদক্ষ কৰ্মীদের স্কিল-প্রিমিয়াম বা শ্রমমূল্যের প্রভেদ বাড়তে শুরু করেছে। অতিমারির অনেক আগে থেকেই প্রযুক্তির উন্নতি দক্ষ শ্রমিকদের দক্ষতর করে তুলতে সহায়তা করছিল। এর ফলে গত ছয় দশক ধরেই এই
স্কিল-প্রিমিয়াম বাড়ছিল। অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে এই স্কিল-প্রিমিয়াম আরও বেড়েছে। এর সরাসরি ফল হল অর্থনৈতিক অসাম্য বৃদ্ধি। অতিমারির সময়ে মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধির প্রসার অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে অটোমেশনের পথ অনেক সুগম করে দিয়েছে।
দু’টি ব্যাপারে ভারতের শ্রমের বাজারের চরিত্র পশ্চিম দুনিয়ার চেয়ে আলাদা। প্রথম, এ দেশে অর্ধেকেরও বেশি লোকের বয়স ত্রিশ বছরের নীচে। অর্থাৎ যুবকদের সংখ্যা প্রৌঢ়দের চেয়ে অনেক বেশি। যে-হেতু প্রৌঢ়রা অতিমারিতে বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন, শ্রমের সরবরাহ অতিমারির জন্য পশ্চিম বিশ্বের মতো ততটা ব্যাহত হয়নি, শুধুমাত্র লকডাউনের দিনগুলি ছাড়া। দ্বিতীয়, ভারতীয় শ্রমিকদের প্রায় নব্বই শতাংশ নথিভুক্ত নন— তাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী। এই শ্রমের বাজারে শ্রমের চুক্তিগুলি কোনও আইনগত পদ্ধতি মেনে চলে না। কাজের নিরাপত্তা নেই, অন্য কোনও সামাজিক সুরক্ষা জালও নেই। এই শ্রমের বাজারটি বহুলাংশে পরিষেবা-ভিত্তিক। এই ধরনের কাজে খুব একটা প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। এ সব কাজের চাহিদা ভারতের মতো প্রভূত জনবহুল দেশে সর্বদাই থাকবে। সুতরাং, দক্ষতা-ভিত্তিক প্রযুক্তি ভারতের এই ধরনের অসংগঠিত শ্রমিকদের অদূর ভবিষ্যতে কর্মচ্যুত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
তবে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরির ফারাক বাড়তেই থাকবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক দানবের প্রসারে প্রযুক্তিতে অতিদক্ষ কর্মীদের চাহিদা আরও বাড়বে। তার ফলে স্কিল-প্রিমিয়াম বাড়তেই থাকবে। প্রশ্ন ওঠে যে, দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীদের বেতনের এত ফারাক থাকা সত্ত্বেও অদক্ষ কর্মীরা লেখাপড়া করে, প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হচ্ছেন না কেন? একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের (‘ক্রস-কান্ট্রি ডিসপ্যারিটিজ় ইন স্কিল প্রিমিয়াম অ্যান্ড স্কিল অ্যাকুইজ়িশন’, বন্দ্যোপাধ্যায়, বসু ও কেলার, ২০২৩) বিশ্লেষণ অনুসারে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দক্ষ শ্রমের বাজারে বেকার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ধরা যাক, অনেক অর্থব্যয় আর পরিশ্রম করে এক জন কোনও প্রযুক্তিতে দক্ষতা লাভ করলেন। তার পরে হয়তো সেই প্রযুক্তিটিরই চাহিদা কমে গেল, যার ফলে তিনি হয়তো আর চাকরিই পেলেন না, বা চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে গেলেন। এই ধরনের ঝুঁকির জন্য ব্যাঙ্কও কাউকে দক্ষতা অর্জন করার জন্য ঋণ দিতে উৎসাহ দেখাবে না। এরই মধ্যে আমরা বিক্ষিপ্ত সাফল্যের সোনালি কাহিনিও শুনি যে, প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব চাষির কন্যা আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন।
তবে সুখবর হল, অতিমারি-উত্তর ভারতে বৃদ্ধিতে কোনও ঘাটতি নেই। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে ২০২৩-২৪’এ ভারতে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। শ্রমিকদের মধ্যে যুবকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভারী শিল্প এবং কৃষিতে শ্রমের সরবরাহ অক্ষুণ্ণ থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের ২০২৩ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, অতিমারির পরে বিভিন্ন সরকারি অনুদান দেশে দারিদ্র কমাতে সহায়তা করেছে। তবে শ্রমের বাজারে স্কিল-প্রিমিয়ামের বৃদ্ধির ফলে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলবে, যদি না সরকার অদক্ষ শ্রমিককে দক্ষ করে তোলার জন্য তৎপর হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy