E-Paper

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, ছাত্র, শিক্ষকদের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়।

স্নেহাশিস সুর

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ০৮:৫৬
The role of radio in the Bangladesh Liberation War, 1971

—প্রতীকী ছবি।

বা‌ংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে আকাশবাণী যে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তা অজানা নয়। কিন্তু সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি বেতারের কর্মী, প্রকৌশলী এবং শিল্পীরা যে ভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছিলেন, তা-ও মনে রাখার মতো ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ নামে খ্যাত ছিল এই বেতার কেন্দ্র।

২৫ মে ১৯৭১, কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতায় (ওই বেতার তরঙ্গে বলা হত ‘মুজিবনগর’) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় দফার সম্প্রচার শুরু হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশের বেতার-কর্মী ও শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হত। কেন্দ্রটির ঠিকানা ছিল ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। ওই বাড়িটি আগে ছিল বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী আস্তানা। ট্রান্সমিটার ছিল ৩৯ সুন্দরীমোহন অ্যাভেনিউ-এর আটতলা বাড়ির ছাদে। দুটো ঠিকানাই ছিল অত্যন্ত গোপন। এই শুরুর আগে আরও দুটো সূচনা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। সে এক লোমহর্ষক কাহিনি।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, ছাত্র, শিক্ষকদের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। বঙ্গবন্ধু ওই রাতেই গ্রেফতার হন। তার আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় ওই রাতেই বেতার কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর বার্তা কোনও ভাবে ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে পৌঁছয়। পর দিন তা মাইকের মাধ্যমে প্রচারিত হয় চট্টগ্রাম শহরে। সেই বার্তা শুনে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রের তিন কর্মী এবং শিল্পী, আবদুল্লা আল ফারুক, বেলাল মহম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দীপ, বেতার কেন্দ্র চালু করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার চালানোর পরিকল্পনা করেন। নিরাপত্তার জন্য চট্টগ্রাম শহরের অনতিদূরে কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র (ট্রান্সমিটার) থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়। কারিগরি বিভাগের কয়েক জনকেও তাঁরা সঙ্গে নেন। কয়েক জন বাঙালি সেনাকেও পান তাঁরা।

২৬ মার্চ ১৯৭১, সন্ধে ৭টা ৪০। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে শুরু হল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার। আবুল কাশেম সন্দীপের উদ্বোধনী ঘোষণার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রথম দু’দিন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বললেও, তার পর ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ হয়ে যায়। কোনও ভাবেই কেউ নিজের নাম বা ওই বেতার কেন্দ্রের অবস্থানের কথা ঘোষণা করতেন না। যে সেনাদল স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, ‌তাঁদের মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাটে বাঙালি সেনা পাকাপাকি ভাবে মোতায়েনের ব্যবস্থা করেন। মেজর জিয়া নিজে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ২৭ মার্চ ১৯৭১-এর সন্ধ্যার ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর নামে পুনরায় স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। কিন্তু আশঙ্কা সত্য করে ৩০ মার্চ ১৯৭১ দুপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনী বোমা ফেলল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের উপর। এটাই ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রথম বোমারু হানা। বেতার কেন্দ্র বিনষ্ট হলেও মুক্তিযুদ্ধের শব্দ-সৈনিকদের কোনও ক্ষতি হয়নি। তাঁরা প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সেখান থেকে।

তাঁদের ঠাঁই হয় ত্রিপুরা সীমান্তের সাব্রুম, রামগড় এলাকায় বাগাফার জঙ্গলে বিএসএফ-এর ৯২ ব্যাটালিয়নের শিবিরে। সেখানে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় ২০০ ওয়াটের ট্রান্সমিটার, এবং এক জন রেডিয়ো অপারেটর। সেখানেই ৩ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে আবার শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রচার। প্রতি দিন হত দু’টি অধিবেশন— সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা, এবং সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১০টা। বাগাফার অনুষ্ঠান আগরতলা থেকেও রিলে করার ব্যবস্থা হয়। ভারত সরকারের নির্দেশে ৮ এপ্রিল ১৯৭১ বাগাফা থেকে কেন্দ্র সরে আসে আগরতলায়। সাময়িক ছেদ পড়ে সম্প্রচারে। আগরতলার জেল রোডে পাঁচ বেতারকর্মীর জায়গা হয়, সেখানেই পর্দা জানলায় গুঁজে বাইরের শব্দ আটকে শুরু হয় স্টুডিয়ো। সেনা এলাকায় একটা ৪০০ ওয়াট ট্রান্সমিটার দিয়েছে ভারত। এখান থেকেই প্রচারিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নেতাদের ভাষণ।

এর পর কলকাতা। ভারতের দেওয়া ৫০ কিলোওয়াটের ট্রান্সমিটার। ২৫ মে ১৯৭১ যে সম্প্রচারের শুরু হয়, তা চলেছিল ২ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত। তবে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই এই প্রচার তরঙ্গের শিরোনাম হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ বেতার’। ঢাকা, চট্টগ্রামের বেতারের অনেক কর্মী, অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, অধ্যাপক পুরোপুরি বা আংশিক সময়ের জন্য যুক্ত হয়ে পড়েন। সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৪২২। ‘চরম পত্র’, ‘পিণ্ডির প্রলাপ’, ‘জল্লাদের দরবার’ প্রভৃতি অনুষ্ঠান, অনেক নতুন গান খুব জনপ্রিয় হয়। এই শিল্পী ও কর্মীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন, তাঁদের সম্প্রচার, উজ্জীবিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। কোনও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বেতারের ভূমিকার নিরিখে এক অনন্য নজির এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangladesh Liberation War Radio India Bangladesh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy