Advertisement
E-Paper

ধোঁয়া দেখলে আগুনের অস্তিত্ব আঁচ করা যেতে পারে

হাওয়ায় প্রশ্ন ঘুরছে— প্রত্যাবর্তন, না পরিবর্তন? দাবি, পাল্টা দাবি বাদ দিলে বাকিটা সঙ্গত ভাবেই অনুমান-নির্ভর।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৩৬

ভোটের বাজারে এখন অনুমান-চর্চার রমরমা! হাটে-মাঠে-চায়ের আড্ডায়-অভিজাত মজলিশে সবাই হারজিতের অঙ্ক কষছেন, স্রেফ কিছু অনুমানে ভর করে। ভোটের সময় এমন হয়েই থাকে। কিন্তু এ বার তার মাত্রা ভিন্ন। কারণ রাজ্যে এ বারের ভোট অনিশ্চয়তার নানা উপাদানে ভরপুর। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আঠারোটি আসনে জয়ের চমক এবং ধাক্কা থেকে যার সূচনা। দু’বছর ধরে পল্লবিত হতে হতে গত দু’মাসে তৃণমূলে ভারীসারি ভাঙনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আরও দানা বেঁধেছে।

হাওয়ায় প্রশ্ন ঘুরছে— প্রত্যাবর্তন, না পরিবর্তন? দাবি, পাল্টা দাবি বাদ দিলে বাকিটা সঙ্গত ভাবেই অনুমান-নির্ভর। তবে চৌত্রিশ বছরের বাম-শাসনে ইতি ঘটিয়ে যিনি ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে নিয়ে মাত্র দশ বছরের মধ্যে এমন অনিশ্চয়তার আলোচনা আদৌ উঠবে কেন, সেই প্রশ্ন নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধীরা শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার ডাক দিয়ে নির্বাচনে লড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বার কিছু মহল থেকে যে ভাবে ‘গেল গেল’ রব তোলা হচ্ছে, সেটা বোধ হয় একটু চোখে পড়ার মতো। ভোটের মুখে শাসক দল ছেড়ে বেরোনোর প্রবণতাও এর পিছনে কিছুটা কাজ করছে।

এ কথা বহু বার আলোচিত যে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা প্রতিপক্ষে যোগ দিতে থাকলে আপাত ভাবে সাধারণের মনে এক ধরনের ‘পারসেপশন’ বা ধারণা তৈরি হয়, যেটা ভোটের মুখে চাপের। অনেকেই ভাবেন, শাসক দলের হাল বেগতিক বুঝে দলত্যাগের হিড়িক। সেখান থেকেই বাড়তে থাকে অনুমান।

কিন্তু বৃহত্তর জনসমর্থনের মাপকাঠিতে এই সব দলত্যাগের গুরুত্ব কতটা? এক জন সাধারণ ভোটার কি মেশিনে বোতাম টেপার সময় কোন নেতা, কোন মন্ত্রী কেন দল ছেড়েছেন, সেটা ভেবে ভোট দেবেন? না কি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সরকার ও শাসক দলের সামগ্রিক কাজকর্মের সঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চাওয়া প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচির তুলনা তাঁর বিবেচনায় অধিক প্রাধান্য পাবে? সোজা কথায়, ভোটার কি তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপনে চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে ভাববেন, না কি বাইরের অন্যান্য অভিযোগ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হবেন? অনুমানের তালিকায় এটিও এ বার খুব প্রাসঙ্গিক।

বস্তুত তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়কেই সেইমতো কৌশল সাজাতে হচ্ছে। বিজেপি মূলত চাইছে, দুর্নীতির অভিযোগ চাপিয়ে সরকারকে জনমানসে কলঙ্কিত করতে। আর তৃণমূলের লক্ষ্য, সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও পরিসর যথাসম্ভব বাড়িয়ে নির্ভরতা অর্থাৎ সমর্থনের ভিত শক্ত করা। কার উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, সে সব ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে এই পর্বে এখন পর্যন্ত কে কোথায় দাঁড়িয়ে তার কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।

এটা ঠিক যে, লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকলে মেদ এবং কাদা দুই-ই শাসকের গায়ে লাগে। কেউ চান বা না-চান, মানুন বা না-মানুন, দলমতনির্বিশেষে তা বাস্তব। অতীতে হয়েছে, এখন হয়, ভবিষ্যতেও হবে। সময়ের দাবিতে অপরাধের চরিত্র, সংজ্ঞা, অভিঘাত বদলাতে পারে। বদলাতে পারে অভিযোগের মাত্রাও। কিন্তু মূল ছবি বিশেষ বদলায় না। মমতার বাংলা হোক, বা যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ, অপশাসন ও দুর্নীতির অভিযোগ সর্বত্র বিরাজমান।

আর দুর্নীতির মতো অভিযোগকে ভোটযুদ্ধে বিরোধীরাই চিরদিন কাজে লাগায় বেশি। সেই সব অভিযোগে কখনও কোনও সারবত্তা থাকে না, তা নয়। তবে সত্যিমিথ্যে সব মিলিয়ে বিরোধীদের চেষ্টা থাকে, অধিকাংশ মানুষকে এ সব অভিযোগ বিশ্বাস করানোর। শাসক প্রাণপণে তার মোকাবিলা করে।

সেই কারণেই দেখা যাচ্ছে, পুরো মেয়াদ মন্ত্রিত্ব করে শেষ লগ্নে দল ছেড়ে চলে আসা শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়েরা এখন পদ্ম-দলে বেশি ‘দামি’। অনুমান করা যায়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাঁদের দু’জনকে বিশেষ ভাবে শো-কেস করার পিছনে কাজ করছে বিজেপির নিজস্ব রণকৌশল।

ধরে নেওয়া হয়েছে, রাজ্যের সদ্যপ্রাক্তন মন্ত্রীদের সামনে তুলে এনে তাঁদের মুখ থেকে সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপশাসন ইত্যাদি অভিযোগ শোনালে আমজনতার কাছে সেটা অনেক সহজে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। তাতে হয়তো ভোটের ময়দানে সস্তায় কিস্তিমাত করারও সুবিধা! নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ সকলেই তাই শুভেন্দু-রাজীবের কাঁধে হাত রাখছেন। নির্বাচনী কোর কমিটিতে রাতারাতি জায়গা দেওয়া হয়েছে তাঁদের। তৃণমূলে থাকতেও এত দ্রুত উত্থান তাঁদের হয়নি!

পাশাপাশি বিজেপি এটাও মনে করে, ওই সব অভিযোগ মোকাবিলায় জড়িয়ে ফেলে তৃণমূলকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে পারলে শাসক দলের প্রচারে উন্নয়ন বা সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় হয়তো কিছুটা পিছনে পড়ে যাবে। ভোটের কেন্দ্রে চলে আসবে দুর্নীতি বনাম ‘স্বচ্ছ’ সরকার গড়ার দাবি। সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। উঁচু থেকে নিচু সর্বস্তরের বিজেপি নেতার বক্তৃতা থেকে এটা পরিষ্কার।

ঠিক যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজ্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পগুলিতে দৃশ্যতই সাড়া পড়েছে। মমতার ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি তাই শাসক দলের কাছে এখন অন্যতম ভোট-ভরসা হয়ে উঠেছে। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ অবশ্যই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ— বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের পরিবারও এখন পাঁচ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য-বিমার কার্ড করাতে যান! জালিয়াতি বা মিথ্যাচার বলে সুবিধাটি হাতছাড়া করতে চান না।

একই কথা প্রযোজ্য রাজ্যের কৃষক বিমার বেলাতেও। রাজ্য কৃষকদের জন্য কী দিচ্ছে এবং কেন্দ্রের অনুরূপ প্রকল্পে কৃষকেরা কী পান, তার তুলনামূলক তালিকা সামনে আসছে বার বার। কিন্তু সেগুলি নস্যাৎ করার মতো যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য যুক্তি ও পরিসংখ্যান বিজেপি এখনও দিতে পারেনি। যা বলা হয়, তাতে কার্যত তথ্যের চেয়ে আবেগ থাকে বেশি!

আমরা জানি, লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরে পর্যালোচনায় বসে মমতা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন, ‘অল ইজ় নট ওয়েল!’ আসলে পঞ্চায়েত, পুরসভার স্তর থেকে দুর্নীতি কী ভাবে বাসা বেঁধেছে এবং নানা জায়গায় সাধারণ মানুষ তার প্রাপ্য থেকে কী ভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, সেটা আড়াল করার মতো পরিস্থিতি সে দিন ছিল না। এর পর কাটমানি ফেরত, ‘দিদিকে বলো’ ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে ভোটের আগে আনা হল ‘দুয়ারে সরকার’ এবং ‘পাড়ায় সমাধান’।

এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে বিতর্ক, সমালোচনা চলতেই পারে। কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগও অস্বাভাবিক নয়। কারণ হাজার সদিচ্ছা সত্ত্বেও কোথাও কোনও সামাজিক কর্মসূচি পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত রাখা যায় না। তবে দেখার হল, যাঁদের কাছে সুবিধা পৌঁছেছে তাঁরা সংখ্যায় বেশি, না কি যাঁদের হাতে পৌঁছয়নি, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ? যুক্তি বলে, যদি অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিতের দলে থাকতেন, প্রকল্পগুলি নিয়ে এত সাড়া তা হলে বোঝা যেত না।

আবার একই ভাবে যে লোকটি চিকিৎসার আশ্বাস, ভাতের আশ্বাস, মেয়ের বিয়ে, সন্তানের লেখাপড়া-সহ বিবিধ সামাজিক সুরক্ষার বলয়ে ঢুকে পড়েন, তাঁর কাছে বাস্তবতার ছবিটিও নিছক অভিযোগের রাজনীতি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। সেখানে কোনও উন্নততর ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তাঁর সামনে না থাকলে প্রতিপক্ষের ‘খেলা’ কঠিন হতে পারে।

নির্মোহ সত্য হল, তেমন বিকল্প বিজেপি এখনও দিতে পারেনি। বরং গুরুত্ব পাচ্ছে তৃণমূল বনাম প্রাক্তন তৃণমূলের দ্বৈরথ! ফলে ক্ষোভের ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে বিজেপির অন্দরেই।

অনুমান বলে, ধোঁয়া থাকলে কোথাও চাপা আগুনও থাকে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy