Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
শতবর্ষের সূচনায় গৌরকিশোর ঘোষ: আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব
Gour Kishore Ghosh

‘বন্দে মানবম্’

উনিশশো আশির দশকের শেষের দিকে মনুষ্যত্বের সন্ধানে বহমান গৌরকিশোর ঘোষের জীবনস্রোত একটি নতুন বাঁক নেয়।

আত্মসমীক্ষক: গৌরকিশোর ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী শীলা ঘোষ, কলকাতা

আত্মসমীক্ষক: গৌরকিশোর ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী শীলা ঘোষ, কলকাতা

সুগত বসু
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২২ ০৪:১০
Share: Save:

উনিশশো আশির দশকের শেষের দিকে মনুষ্যত্বের সন্ধানে বহমান গৌরকিশোর ঘোষের জীবনস্রোত একটি নতুন বাঁক নেয়। গুজরাতে গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে যোগদান করার আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁর মনে গভীর দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘আকর্ষণের এবং বিকর্ষণের’। গান্ধী ঈশ্বরের একান্ত অনুগত, গৌরকিশোর ভাবলেন, “গান্ধী আজীবন মদ্যপানের বিরোধিতা করে এসেছেন। আর আমি মদ্যপায়ী।” সেই তরুণ বয়স থেকে গৌরকিশোরের ‘মানসিকতা’ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘যুক্তিশীল মানবতাবাদী আবহে’ লালিত। তার সঙ্গে মিশেছিল রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্ম বা ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’। সেই মানসিকতার সঙ্গে কি গান্ধীর সত্যের রফা হওয়া সম্ভব? এম এন রায় শিখিয়েছিলেন যে, মানুষের যুক্তিবাদী সত্তাই তার বিবেকের উৎস। গান্ধীর সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই স্বীকার করতে হল, ‘যুক্তির একটা সীমা আছে’।

যা-ই হোক, গুজরাত দেখা হয়নি এবং সেখানে গেলে মার্টিন লুথার কিং-এর কিছু অনুগামীর সঙ্গে আলাপ হবে, এই ভেবে গৌরকিশোর তাঁর গান্ধী-যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। বাসন মাজতে মাজতে দলিত সঙ্গী রতনুর কাছ থেকে শুনলেন কী ভাবে মহাত্মা তাঁদের আত্মমর্যাদায় দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই ১৯৪৭-এ গান্ধী দিল্লিতে তাঁদের তথাকথিত ভাঙ্গি কলোনিতে থেকেছিলেন। গৌরকিশোরের মনে পড়ল তিনিও গান্ধীর ম্যাজিক প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রেড ক্রসের ভলান্টিয়ার হিসেবে নোয়াখালিতে দেখেছিলেন যে গ্রামে গান্ধী তখনও পৌঁছননি সেগুলি জনশূন্য, আর যেখানেই গান্ধীর পদচিহ্ন পড়েছে সেখানে মানুষ ফিরে এসেছে। ১৯৮৮-তে সহযাত্রীদের কাছ থেকে তিনি শিখলেন: “মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির দূরত্বটা দূর করার জন্য মানুষে প্রকৃতিতে সেতু বাঁধা দরকার, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর দূরত্বটা দূর করার জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের সেতু বাঁধা দরকার, আবার নিজের সঙ্গে নিজের সত্তার দূরত্বটা দূর করার জন্য বিবেক ইত্যাদির সঙ্গে সেতু বাঁধা দরকার।”

২ অক্টোবর ডান্ডি থেকে রওনা হয়ে ৮ দিন পরে আমদাবাদের সাবরমতি আশ্রমে পৌঁছনো গেল। সেখানকার সভায় সর্বধর্মের মানুষের নিজ নিজ ভাষায় প্রার্থনা সঙ্গীত শুনে গৌরকিশোরের মনে কেমন যেন একটা ‘এপিফ্যানি’ হল। মসজিদ, মন্দির, গির্জার প্রাঙ্গণে আমাদের এ দিকেও যদি সব ধর্মের বাণী শোনানো যায়, তা হলে হয়তো বা বিদ্বেষ-বিষ নাশ করা যেতে পারে। তাঁর মতে অবশ্যই এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে হবে ‘খোলা আকাশের নীচে’। যাত্রা শুরুর আগে মনে যে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল যাত্রাশেষে তা সবই মুছে গেল। গৌরকিশোরের উপলব্ধি: “বিবিধের মাঝে মিলনের সেতু গড়ে তোলা এমন একটা কাজ, যে কাজে ঈশ্বরবাদী গান্ধীর অনুগামী এবং আমার মতো একজন অকিঞ্চিৎকর নিরীশ্বরবাদী সানন্দে এসে হাত মেলাতে পারি।”

এর ঠিক এক বছর বাদে বিহারের ভাগলপুর জেলায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, ২০০-র বেশি গ্রামে প্রায় চার হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছিল, ৮৭৫ মুসলমান ও ৫০ জন হিন্দুর প্রাণ গিয়েছিল, আরও ১০০ জনের বেশি মানুষের হদিস মেলেনি। ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারি, মার্চ, মে মাসে যে গৌরকিশোর তিন বার ভাগলপুর গিয়েছিলেন সেগুলিকে গান্ধী-যাত্রা আখ্যাই দিতে হয়। সেই ১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে বসে বিহারে হিংসার খবর পেয়ে ক্ষিপ্ত মহাত্মা বলেছিলেন, “ইজ় ইট ন্যাশনালিজ়ম টু সিক বারবারাসলি টু ক্রাশ দ্য ফোর্টিন পার্সেন্ট অব দ্য মুসলিমস ইন বিহার?” আগুনে ঝলসে যাওয়া বিহারে শুশ্রূষার স্পর্শ দিতে তিনি অবশেষে আবদুল গফ্ফর খানকে নিয়ে পৌঁছেছিলেন ১৯৪৭-এর মার্চ মাসে।

গান্ধীর পথ ধরেই গৌরকিশোর ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে চিহ্নিত করেছিলেন মনুষ্যত্বের শত্রু হিসেবে। ১৭ জুন ১৯৯০-এ আনন্দবাজারে প্রকাশিত দীর্ঘ লেখায় মনুষ্যত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন কতিপয় সাহসী ব্যক্তির মধ্যে। প্রতিভা সিংহ, জেনি শবনম, কিশোরী দেবী এবং গিরিজা দেবী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মুসলমান প্রতিবেশীদের বাঁচাতে। আর ‘হীরা কা টুকরা’ ফুয়াদ আহমেদ দলিত খেতমজুরদের তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

‘সত্তর পার হওয়া বিবেকী প্রতিবাদী’ গৌরকিশোরের ১৯৯৩-এ লেখা ‘দেশদ্রোহ দেশপ্রেম’ নিবন্ধের মূল কথাটি আজ আবার নতুন করে প্রাসঙ্গিক। এও গান্ধীকে দিয়ে শুরু, যাঁকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী ‘নাঙ্গা ফকির’ বলে বিদ্রুপ করেছিল, তিনিই তো আমাদের ‘জাতির জনক’। সেখান থেকে গৌরকিশোর তৈরি করছেন স্বাধীন ‘ভারতের ঔপনিবেশিক অহমিকা’র এক বিবেকময় ‘ক্রিটিক’। ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস’, আশায় বুক বেঁধে তিনি ঘোষণা করছেন, “আমাদের নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক ভড়কি দিয়ে বেশি দিন ভুলিয়ে রাখা যাবে না।” ‘উপনিবেশবাদকে ভারত ঘৃণা করে’। কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, “ভারত সেই ঘৃণিত উপনিবেশবাদের ঔদ্ধত্যের ফাঁদেই কি পা বাড়িয়ে দেয়নি?”

বালকবেলায় নাগা রানি গইদালোর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে সাড়া জাগিয়েছিল। পরে তিনি কোহিমা যান, সেখান থেকে খোনেমা, যে গ্রামে ১৯০৫ সালে ফিজোর জন্ম। এই লেখায় গৌরকিশোর সুভাষচন্দ্র বসু ও আঙ্গামি জাপু ফিজোর তুলনামূলক আলোচনা করলেন, “বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি পেতে হবে, এই ছিল দুজনেরই মূল প্রেরণা। বিদেশী শাসন থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে হবে, এই ছিল দুজনেরই স্বপ্ন। এই স্বপ্ন সফল করার জন্য দুজনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন বিদেশী অর্থাৎ ব্রিটিশ ফৌজের বিরুদ্ধে। বর্মার রণাঙ্গনে... সুভাষের মতো ফিজোরও আশা ছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।” ১৯৪৭ বা ১৯৫০-এর চৌকাঠ পেরিয়ে গৌরকিশোর আর একটি তুলনা টানলেন। তাঁর সোজা বক্তব্য, “ভারতের কলোনি সম্পর্কে চার্চিলের যে মনোভাব ছিল, নাগাভূমি সম্পর্কে নেহরুর মনোভাব তার চাইতে আলাদা কিছু ছিল না।” ভাগ্যের পরিহাস, “সেই মতলববাজ ব্রিটিশের মানচিত্রই আমরা সার বলে গ্রহণ করেছি।”

কাশ্মীর প্রশ্ন তোলেন তিনি তাঁর অনবদ্য ভঙ্গিতে: “কাশ্মীরের বখেড়াটা যথাসম্ভব বোঝার চেষ্টা করা যাক।” মন্তব্য করেছেন, “বন্দুক দিয়েই ভারত কাশ্মীরকে তাঁবে রাখবে। ভালবাসার আর দরকার নেই।” তবু ‘বিবেকী মানুষের’ প্রতি গৌরকিশোরের কিছু সদুপদেশ আছে। তাদের “উচিত প্রচলিত বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে খোলা চোখে সমগ্র সমস্যাটাকে যুক্তির আলোতে বার বার বিচার করে দেখা।”

কাশ্মীরের ইতিহাস পর্যালোচনার পাশাপাশি গৌরকিশোর তুলে ধরেছেন এক বিবেকবান ও যুক্তিশীল নীতি। তিনি ঠিকই ধরেছেন যে, “মোগল আমলে কাশ্মীর নামমাত্র মোগলাধিকারে ছিল।” আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ সে যুগে ছিল না। এখন আধুনিক গণতন্ত্রে নীতিগুলি লেখক সাজিয়েছেন এই ভাবে। “১) প্রকৃত দেশপ্রেম আর রাষ্ট্রীয়তাবাদ এক জিনিস নয়। ২) রাষ্ট্রীয়তাবাদ অর্থাৎ স্টেটিজম আর গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলতে পারে না। ৩) গণতন্ত্রের মূল কথাই হল সম্মতির শাসন।” গৌরকিশোর বেশ জোরের সঙ্গে লিখেছেন, “খেয়াল করবেন, জবরদস্তির শাসন নয়, সম্মতির শাসন।”

অসুস্থ হওয়ার আগে গৌরকিশোরের শেষের দিকের লেখায় পড়ি সেই প্রজন্মের এক আত্মসমীক্ষার সুর। মনে পড়ে, আমার বাবা শিশিরকুমার বসুরও শেষ লেখা ২০০০ সালে ১৫ অগস্ট, ‘জাতীয়তাবাদীর আত্মসমীক্ষা’। দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেন এক মানবিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা; স্বাধীন রাষ্ট্রের অতিকেন্দ্রিকতা, মিথ্যাচার ও ঔপনিবেশিক আস্ফালন তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। গৌরকিশোর নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন দেশপ্রেমের প্রকৃত সংজ্ঞা: “যে দেশপ্রেম মাটি নিয়েই কেবল কামড়াকামড়ি করে, সে দেশপ্রেম ভুয়া। যে দেশপ্রেম মানবিকতাকে মূল্য দেয় সেই দেশপ্রেম খাঁটি।”

১৯৭৫-এর জেলের খাতা। সেখানে দেশবন্ধুর ১৯১৭-র বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি: “আই ডু নট থিঙ্ক দ্য গড অব হিউম্যানিটি ওয়জ় ক্রুসিফায়েড ওনলি ওয়ান্স। টাইর‌্যান্টস অ্যান্ড অপ্রেসর্স হ্যাভ ক্রুসিফায়েড হিউম্যানিটি এগেন অ্যান্ড এগেন। এভরি আউটরেজ অন হিউম্যানিটি ইজ় আ ফ্রেশ নেল ড্রিভেন থ্রু হিজ় সেক্রেড ফ্লেশ।” গৌরকিশোর লিখে রেখেছেন “দেশবন্ধুর দ্য গড অব হিউম্যানিটি, রবীন্দ্রনাথের নিখিল মানবসত্তা, জয় তারই হোক। চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। এই সত্য আমাদের চিত্তেও উদ্ভাসিত হোক, সদা ভাস্বর হয়ে উঠুক।”

প্রেসিডেন্সি জেলের একটি দৃশ্য। জনসংঘর্ষ সত্যাগ্রহীর দল আদালত থেকে তাদের ১৯ নম্বর ফাইলে ফিরছে আর ধ্বনি দিচ্ছে: “জরুরি অবস্থা তুলে নাও, বন্দে মাতরম্, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও, বন্দে মাতরম্।” গৌরকিশোরের মনে হল দেশমাতৃকার অস্বচ্ছ রূপটির তুলনায় মানুষের চেহারা স্পষ্টতর। তাই, তাঁর প্রিয় ধ্বনি দিয়েই তাঁর শতবর্ষ পালন করা যেতে পারে: ‘বন্দে মানবম্’। হে মানব, তোমারই হউক জয়।

(শেষ)

ঋণ: গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম-শতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি। শতবর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পঠিত বক্তৃতা।

গার্ডিনার প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gour Kishore Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE