Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Poverty

দারিদ্র আর ক্ষুধা কি আলাদা

যাঁরা হাতে-কলমে এই ধরনের গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কাজ করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতায় থাকবে পুষ্টির থেকে প্রসাধনের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৪২
Share: Save:

সম্প্রতি ভারতে ক্ষুধা ও বহুমাত্রিক দারিদ্র বিষয়ে দু’টি পরিসংখ্যান প্রকাশিত। তার ভিতরে অসংখ্য তথ্য, তাকে ঘিরে অজস্র তর্ক। কিন্তু, মনে রাখা দরকার যে, তথ্য কিন্তু আজ আর কেবলমাত্র তথ্য নয়। এখন বলা হচ্ছে, ‘ডেটা ইজ় ডিসকোর্স’। আগে মনে করা হত যে, কোনও ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তথ্যের প্রয়োজন হয়। এখন তথ্য নিজেই ভাষ্য। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন এবং একগুচ্ছ বিষয়ের হিউম্যানিটিজ় থেকে সোশ্যাল সায়েন্সের দিকে যাত্রা-সহ আরও বিভিন্ন কারণে তথ্য আজ আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপী।

এবং, একই সঙ্গে তথ্য অতি ক্ষমতাবান। ক্ষুধার এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর এই তথ্যলাঞ্ছিত সময়ে যখন গণবণ্টন ব্যবস্থার সুফল নেওয়ার জন্য মানুষকে ডিজিটাল তথ্যে পরিণত হতে হয়, তখন যে মানুষের আধার কার্ড নেই, অথবা আধার কার্ডের আঙুলের ছাপের সঙ্গে এই সময়ের আঙুলের ছাপ মিলছে না— তিনি তথ্য বিভ্রান্তির দায়ে এমনকি গণবণ্টন ব্যবস্থার সামান্য সুরাহাটুকু থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত দুই পরিসংখ্যান বলছে যে, বহুমাত্রিক দারিদ্র কমেছে, কিন্তু পরিপার্শ্বের তুলনায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির দাপট কমেনি, বরং বেড়েছে। দারিদ্র ও ক্ষুধা কি তবে দুই পৃথক ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব? কেউ বলতে পারেন যে, আয় সামান্য বাড়লে মানুষ পুষ্টির থেকে প্রসাধনের দিকে গুরুত্ব দেন। যাঁরা হাতে-কলমে এই ধরনের গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কাজ করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতায় থাকবে পুষ্টির থেকে প্রসাধনের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটি ডিমের দাম মোটামুটি ভাবে একটি বড় শ্যাম্পুর স্যাশের সমান থাকে। আমাদের এক অধ্যাপক এই অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে বলেছিলেন, কী ভাবে এমন একটি গবেষণায় কিশোর-কিশোরীরা জানায়, “রোজ একটা ডিম খেলাম কি না সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু শ্যাম্পু করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রকাশ্যে সেটা বোঝা যায়। বন্ধুসমাজে এর একটা প্রভাব আছে।” কিন্তু এর ফলে খিদে মিথ্যে হয়ে যায় না। অপুষ্টি মিথ্যে হয়ে যায় না।

আয় সামান্য বাড়লে ভোক্তার আগ্রহ পুষ্টির থেকে মনোহারী বা বিলাসবহুল পণ্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াই নয়, পর্যাপ্ত বৃদ্ধির জন্য আবশ্যক যে পুষ্টি, তার প্রতি বহুস্তরীয় উদাসীনতাও একটা বড় কারণ। পরিবারের ভিতরে লিঙ্গবৈষম্য,‌ জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যাভ্যাস-সহ বিভিন্ন এককে এর বিস্তার ধরতে পারা যায়। একটি সচ্ছল পরিবারের একটি সন্তান পরিপুষ্ট এবং অন্যটি অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণের ফলে রুগ্ণ— এই চিত্রও কিছু আশ্চর্যের নয়। মফস্‌সল শহরের সম্ভ্রান্ত কোনও একটি গার্লস কলেজে বিত্তশালী পরিবার থেকে পড়তে আসা ছাত্রীদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে, খাদ্য গ্রহণে অনীহা এবং তা থেকে হিমোগ্লোবিন কম হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় তাদের একটা বড় অংশ আক্রান্ত। অথচ, তাদের মধ্যেই কোনও কোনও পরিবারে তাদের ভাই অথবা দাদা (বিশেষত ভাই হলে, বয়সে ছোট তদুপরি পুত্রসন্তান) যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। বোঝা যায় যে, কন্যার খাদ্য গ্রহণে অনীহার বিষয়টি নিয়ে পরিবারের তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই।

জীবনযাত্রার ধরন ও খাদ্যাভ্যাস এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রার ধরন বলতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা গ্রামীণ কৃষিশ্রমিক অথবা মফস্‌সলের গৃহপরিচারিকার আয়ের উপর চলা কোনও পরিবারে মোবাইল ফোনে অফুরান কথা বলার সুবিধা পাওয়া অথবা কেব্‌ল টিভির বিনোদনের জন্য মাসিক খরচের বরাদ্দ যে ভাবে গুরুত্ব পায়, পুষ্টির কথা সেই ভাবে উঠে আসে না। আর খাদ্যাভ্যাস? দ্রুত খিদে মেটানোর জন্য কম দামের প্যাকেটজাত খাবার গরম জলে ফুটিয়ে মশলা ঢেলে খাওয়াই হোক, অথবা রেস্তরাঁ থেকে খাবার অর্ডার করে খাওয়ার সময়; বহু ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র স্বাদ গুরুত্ব পায়, পুষ্টি নয়।

তবে কি এই সব শুধু কথার কথা? খিদে কি শুধুই তথ্য? একটি আলোচনা সভার কথা মনে পড়ে যায়। মানব-উন্নয়ন ও ক্ষুধা নিবারণ বিষয়ক সারা দিনের একটি আলোচনায় তখন বিকেল গড়িয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট বক্তা মঞ্চ থেকে খেয়াল করেন যে, অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি বসা এক দল গবেষক কেমন যেন একটু অস্থির হয়ে পড়ছেন। মঞ্চ থেকে বক্তা প্রশ্ন করে জানতে চান, তাঁর ওই প্রস্তাবিত মডেল অথবা বক্তব্যের সঙ্গে ওঁদের বড় কোনও মতানৈক্য হচ্ছে কি না। প্রত্যুত্তরে সেই গবেষকের দল জানান যে, বক্তব্য নিয়ে তাঁদের কোনও দ্বিমত নেই। তাঁরা নিশ্চিত, এই উন্নয়ন মডেল সফল হলে ক্ষুধা কমবে। শুধু দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি বলে খিদেয় একটু অস্থির লাগছে।

মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ইউএনডিপি, অক্সফ্যাম ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে ক্ষুধা, অসাম্য, দারিদ্র বা আয়-বৈষম্যের মতো বিষয় নিয়ে রিপোর্ট আসে। তার প্রচ্ছদে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে বুভুক্ষু চোখ। কী ভাবে এই তথ্য সংগ্রহ হয়? কারা করেন? কেন করেন? তাঁদের অভিসন্ধি কী? এই সমস্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা তো আছেই, তার সঙ্গেই আছে খুব সহজে নিজের সুবিধামতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সেই তথ্যকে ব্যবহার করা। সেই তথ্য নিয়ে চলে কাটা-ছেঁড়া, বিশ্লেষণ। সেমিনার হয়। লেখা হয় গবেষণাপত্র। গ্রহণ এবং বর্জনের খেলা চলে।

কিন্তু সেই সব তথ্য, পরিসংখ্যান, তর্ক, গ্রহণ ও বর্জন পার করে দারিদ্র কমেছে মনে করে শ্লাঘা অনুভব করার আগে ফ্লাইওভারের নীচে, রেল স্টেশনের পাশে অথবা গ্রামের উপান্তে বাস করা প্রান্তিক মানুষদের ঘরে কর্মহীনতা, আয় হ্রাস পাওয়া, মূল্যবৃদ্ধি— এ রকম নানা আঘাতে নানা দিক থেকে একটু একটু করে তুবড়ে যাওয়া হাঁড়িটার কথা ভাবা দরকার। হাঁড়িটা কী ভাবে চাল আর জল সমেত প্রতি দিন আগুনে বসতে পারে, তার কথা ভাবা দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poverty Hunger Index
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE