Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
coronavirus

রাজনীতি ছাড়া বিজ্ঞান হয় না

লেওন্টিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান হল, জীব এবং পরিবেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার বাস্তবতাকে চিহ্নিতকরণ

সন্দীপ চৌবে
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২১ ০৫:৩৭
Share: Save:

চলে গেলেন রিচার্ড চার্লস লেওন্টিন (ছবি), ৪ জুলাই। তিনি ছিলেন এক দিকে এভলিউশানারি বায়োলজিস্ট, গণিতবিদ, জিনতত্ত্ববিদ ও শিক্ষক এবং অন্য দিকে রাজনৈতিক কর্মী। প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচার এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অতিমারির বিপদ নিয়ে যে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে গিয়েছেন, লেওন্টিন ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য।

১৯২৯ সালে জন্ম। প্রথমে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং পরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা। প্রথম থেকেই তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও গবেষণার কাজ ছিল অবিচ্ছেদ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে গবেষণার কাজ পরিচালনা করা যায় না। এটি তাঁর নিজের কাজ থেকেই প্রমাণিত হয়েছিল। তাঁর কাজে তিনি মার্ক্সবাদী দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন, তা প্রায়শই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করেছে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি বিবর্তন এবং জেনেটিক্স অধ্যয়নের জন্য মলিকিউলার বায়োলজি ও কম্পিউটার-নির্ভর গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছিলেন। এখানে তাঁর কয়েকটি মূল বৈজ্ঞানিক অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যা জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

লেওন্টিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান হল, জীব এবং পরিবেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার বাস্তবতাকে চিহ্নিতকরণ। ‘অর্গানিজ়ম অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ নামের একটি দূরদর্শী নিবন্ধে লেওন্টিন দেখান যে, জীব এবং তার পরিবেশের মধ্যেকার সম্পর্ক মূলত দ্বিমুখী। জীববিজ্ঞানের চিন্তাকাঠামোয় এটি একটি পর্বান্তরের সূচক। প্রচলিত ডারউইনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিবেশ আগে থেকেই গঠিত একটা শূন্য আধার, যার মধ্যে জীব বাস করে। তার বিপরীতে, লেওন্টিন ‘নিশ কনস্ট্রাকশন’ তত্ত্বের বিশিষ্টতার উপর জোর দিয়েছিলেন, যে তত্ত্ব অনুযায়ী জীব তাদের কার্যকলাপ এবং সিদ্ধান্তগুলির মাধ্যমে নিজস্ব পরিবেশের পরিবর্তন ঘটায়। অর্থাৎ, জীব এবং পরিবেশ পরস্পরকে সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সংজ্ঞায়িত করে। এই ধারণাটি প্রভাবিত করেছে বিভিন্ন প্রজন্মের জীববিজ্ঞানী-সহ পরিবেশবিদদের, যাঁরা আমাদের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারে মানুষের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। পরিবেশের এই ধরনের পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার উপায়গুলিও পাল্টেছে। যেমন, মহামারি-বিশেষজ্ঞ রব ওয়ালেস ক্রমবর্ধমান ভাইরাল সংক্রমণের (যেমন সার্স, মার্স, কোভিড-১৯) পিছনে কৃষিকে বড় শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার ও বহুজাতিক কর্পোরেশনের মুনাফা বাড়িয়ে চলার মডেলটির ভূমিকাকে চিহ্নিত করেছেন।

লেওন্টিন জিনগত নির্ধারণবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এই মতবাদ বলে যে, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্বিশেষে মানুষের আচরণ সরাসরি তার নিজস্ব জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশ্বাসটি বিদ্যাচর্চার জগতে এবং সার্বিক ভাবে সমাজে প্রচলিত আছে। এই জাতীয় জেনেটিক নির্ধারণবাদ এই যুক্তি দেয় যে, বিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচিত জিনই মানুষের সামাজিক সংগঠনকে নির্ধারণ করে। বিশেষত, এই মতবাদ পুরুষের আধিপত্য, শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, আঞ্চলিকতা এবং আগ্রাসনকে মানুষের জিনের পরিণতি হিসেবে বিবেচনা করে। লেওন্টিন এই তত্ত্বটির সমালোচনা করে দেখিয়েছিলেন যে, এ জাতীয় তত্ত্ব এমন ভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, যাতে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে তা খারিজ করা অসম্ভব। তিনি আরও দেখান যে, মানুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের কোনও প্রমাণ নেই এবং প্রচলিত বিবর্তন বিষয়ক যুক্তিগুলি কাল্পনিক গল্পমাত্র। দারিদ্র ও অপরাধের মতো সামাজিক সমস্যাগুলিকে জিন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টাগুলির উপর বড় রকমের আঘাত হানে তাঁর এই কাজ।

সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার উদাহরণ আমরা পাই ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়ে। ১৯৭২ সালে একটি যুগান্তকারী গবেষণায় লেওন্টিন কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার ভেরিয়েশন বা ‘প্রকরণ’-এর জন্য দায়ী কারণগুলি বিচার-বিশ্লেষণ করেন। যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে একটি জীব অপর জীবের থেকে পৃথক হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাদের ভেরিয়েশন বলা হয়। লেওন্টিন শনাক্ত করেছিলেন যে, মানুষের জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ প্রকরণ স্থানীয় ভৌগোলিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পাওয়া যায় এবং পারম্পরিক ‘বর্ণ’ গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার পার্থক্যগুলি মানুষের জিনগত প্রকরণের একটি ছোট অংশমাত্র (১-১৫%)। এক কথায় বর্ণকে একটি বৈজ্ঞানিক একক হিসাবে চিহ্নিত করে কোনও জনগোষ্ঠীর জিনগত বৈচিত্র‍ ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তাঁর এই কাজ সেই সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক সংস্কারের ভিত্তিতে আঘাত হানে, যে সংস্কার অনুযায়ী ‘বর্ণ’ একটি বিজ্ঞানসম্মত জাতিগত একক এবং যা বৈধতা দেয় ‘বর্ণবাদ’কে।

এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি, লেওন্টিন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় অন্য র‌্যাডিকাল বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ‘সায়েন্স ফর দ্য পিপল’ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন, যা গণতান্ত্রিক এবং ‘ইনক্লুসিভ’ বিজ্ঞানের পক্ষে সওয়াল করেছিল। গোপন যুদ্ধ গবেষণায় জড়িত থাকার কারণে লেওন্টিন আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। যাঁরা স্থিতাবস্থার পক্ষ অনুসরণ করতেন সেই সব বিজ্ঞানী লেওন্টিনের র‌্যাডিকাল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে প্রায়শই ক্ষুব্ধ হতেন। তা সত্ত্বেও তিনি বরাবর তাঁর কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অটল থেকেছেন। তাঁর গবেষণা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ছিলেন মার্ক্সবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড লেভিন্স। তাঁরা দু’জন মিলে দু’টি বিখ্যাত বই রচনা করেন: দ্য ডায়ালেক্টিক্যাল বায়োলজিস্ট এবং বায়োলজি আন্ডার দি ইনফ্লুয়েন্স। বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চায় বই দু’টির প্রভাব যেমন গভীর, অবদানও তেমনই সুদূরপ্রসারী।

ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য ফিজ়িক্স অব কমপ্লেক্স সিস্টেমস, জার্মানি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE