Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Abhijit Vinayak Banerjee

Opinion: উপর থেকে জ্ঞান আসবে নীচে, এমন গণতন্ত্র কাম্য নয়, বললেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের ‘সোনালি অতীত’ আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে যাই, পঁচাত্তর বছর আগে কী দুর্দশা ছিল।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২১ ০৬:৪৭
Share: Save:

প্রশ্ন: ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষের সূচনা হতে চলেছে। উদ্‌যাপন করার সত্যি কিছু আছে কি?

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়: আছে বইকি। আমরা আমাদের ‘সোনালি অতীত’ আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে যাই, পঁচাত্তর বছর আগে ভারতীয়দের কী দুর্দশা ছিল। দুর্ভিক্ষ, অর্ধাহার-অনাহার, দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের উপর নানা রকম অন্যায়-অবিচার, বিপুল বৈষম্য, এই ছিল তখন ভারতের চেহারা। মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল বড়জোর দশ শতাংশ, গড় আয়ু ছিল বত্রিশ বছর। আজ গড় আয়ু প্রায় সত্তর বছর, মেয়েদের সাক্ষরতার হার সত্তর শতাংশ। এমনকি দলিত সম্প্রদায়েও যেখানে ১৯৬১ সালে মাত্র দশ শতাংশ সাক্ষর ছিলেন, সেখানে ২০১১ সালে ছিলেন ৬৬ শতাংশ— যা জাতীয় গড়ের প্রায় কাছাকাছিই। স্বাধীনতার সময়ে কেউ কল্পনা করতে পারত না যে, সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে কর্তৃত্বের পদে দলিত বা মহিলারা থাকবেন, উচ্চবর্ণের পুরুষও তাঁদের নির্দেশমতো কাজ করবেন। আজ প্রশাসনে, বাণিজ্যে, পরিষেবায়, সমাজ-সংস্কৃতির নানা সংস্থায় শীর্ষ পদে রয়েছেন দলিত ও মহিলারা। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মেয়েরা এবং দলিতরা কেবল প্রধানের চেয়ারে বসে নেই, নেতৃত্বের চেহারাটাও বদলে দিচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রে, কর্পোরেট সংস্থার ‘সিইও’ পদে মেয়েদের দেখলে আর কেউ আশ্চর্য হন না। যে ভয়াবহ বৈষম্য ভারতে ছিল, তা থেকে অনেকটা এগিয়েছি আমরা।

প্র: বৈষম্য কমাতে সংরক্ষণই কি সমাধান?

উ: বৈষম্য কমেছে নানা কারণে। তার মধ্যে একটা হল, যে সব এলাকায় স্কুল-কলেজ ছিল না, সেখানে স্কুল-কলেজ খোলা হয়েছে। এখন ভারতের প্রায় প্রত্যেক গ্রামে অন্তত প্রাইমারি স্কুল একটা আছে। সেই স্কুলগুলো নিশ্চয়ই যত ভাল চলতে পারত অতটা ভাল চলে না, তবু তাতে সুযোগ অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নানা চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ বেড়েছে, তার সাহায্যে গ্রামের গরিব এবং নিম্নবর্গেরা শহরে, এমনকি গ্রামেও, নানাবিধ নতুন কাজ পাচ্ছেন। তাতে তাঁদের আয় হচ্ছে, স্কুলের ফি দিতে হলে তা দিতে পারেন তাঁরা। হাসপাতাল যাওয়ার সামর্থ্য আছে। তৃতীয়ত, একশো দিনের কাজ-সহ নানা সরকারি প্রকল্প থেকে অনেকেই কমবেশি লাভ পেয়েছেন।

তার মানে এই নয় যে, সংরক্ষণের কোনও ভূমিকা নেই আজ। সংরক্ষণ না থাকলে কী হয়, সেটা উত্তর ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে প্রকট— ২০১৪ আর ২০১৯ সালে হিন্দি বলয়ে বিজয়ী বিজেপির ৪৫ শতাংশ সাংসদ ছিলেন উচ্চবর্ণ, যাঁরা জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরও কম। কিন্তু যদি তফসিলি জাতি-জনজাতির জন্য সংরক্ষিত আসন বাদ দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাচ্ছে, অসংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ ছিলেন উচ্চবর্ণ। অন্যান্য দলের সাংসদদের মধ্যে উচ্চবর্ণ ছিলেন ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ, সংরক্ষণই বিজেপি নেতাদের বাধ্য করছে নিম্নবর্ণদের আসন দিতে, না হলে উচ্চবর্ণ নেতাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ঠেকানো মুশকিল হত। যে হেতু সংসদে আজও মেয়েদের সংরক্ষণ নেই— মাত্র চোদ্দো শতাংশ সাংসদ মহিলা।

শুধু রাজনীতি নয়, জীবনের সব স্তরে, যেখানেই সংরক্ষণ নেই, সেখানে প্রায়ই উচ্চবর্ণদের একটা অলিখিত প্রাধান্য তৈরি হয়, কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা নানা দিক থেকে বর্ণের নিরিখে এক হয়ে কাজ করে। এর একটা বড় কারণ, উচ্চবর্ণরা উত্তরাধিকার সূত্রে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সম্পদ (কালচারাল ক্যাপিটাল) পান, কারণ অতীতে শুধু তাঁরাই লেখাপড়া করতে পারতেন, এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক আচার-উৎসবে যোগ দিতে পারতেন। এক জন নিম্নবর্ণ মানুষের সমান বুদ্ধি এবং কর্মক্ষমতা থাকলেও তিনি অনেক সময়ে একটু পিছিয়ে পড়েন, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে শুরু করেন— যাঁরা পেশাগত কাজটা বেশি ভাল পারেন, তাঁরাও নিজেদের ঠিকমতো উপস্থাপনা করতে পারেন না। হয়তো ইংরেজিটা তত ঝকঝকে হয় না। এক প্রজন্মে কয়েক হাজার বছরের ঘাটতি পূরণ হয় না।

তবে সংরক্ষণের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যা এই যে, এখন যে ভাবে সংরক্ষণ করা হয় তাতে সংরক্ষিত বর্ণগুলির মধ্যে কে ধনী আর কে গরিব, তার বিচার করা হয় না। উল্টো দিকে আর্থিক ভাবে দুর্বল শ্রেণিদের জন্য যে নতুন সংরক্ষণ চালু হয়েছে, তাতে বর্ণের কোনও উল্লেখ নেই।

আমার মনে হয়, এই দুটোকে জুড়ে দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, ‘পয়েন্ট’ দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে দরিদ্র হওয়ার জন্য, নিম্নবর্ণ হওয়ার জন্য, অনাথ শিশুদের জন্য; প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল থেকে পাশ-করে আসার জন্য বাড়তি পয়েন্ট পাওয়া যাবে। তা ছাড়াও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরও কার্যকর হয়ে ওঠে। যেমন, বিহারে দেখা গিয়েছে, পঞ্চায়েতের তফসিলি জাতি-জনজাতির সদস্যদের যদি বর্ণহিন্দু প্রধানের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তাঁরা অনেক সময়ে বিফল হন। কিন্তু যদি অভিযোগ নিষ্পত্তির একটা ব্যবস্থা থাকে, তা হলে সেই ঘাটতিটা অনেকটাই পূরণ হয়ে যেতে পারে।

প্র: ব্যবস্থায় পরিবর্তন কি শুধু সরকারই করবে? আপনি তো মানুষের পছন্দকেও (‘চয়েস’) গুরুত্ব দেন।

উ: কেবল নিয়ম পাল্টে, বা ক্ষমতাসীন দলকে পাল্টে এই ধরনের সংস্কার অবশ্যই হয় না। মানুষের মনের পরিবর্তন চাই। যে সব জায়গায় পরিবর্তন হলেও অত্যন্ত ধীরে হচ্ছে, সেগুলো প্রথম চোখে পড়ে। যেমন, ভিন্ন ধর্ম কিংবা ভিন্ন জাতে বিয়ে সম্পর্কে মনোভাবে তেমন পরিবর্তন হয়নি। আজকের তরুণ-তরুণীরাও জাত-ধর্মের হিসেব কষে বিয়ে করে। আবার, স্কুলের মিড-ডে মিলকে ঘিরে একটা সাম্যের পরিসর তৈরি হয়েছে — দলিত মহিলাদের রান্না-করা খাবার সেখানে উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েরাও খাচ্ছে। তবু ছুতমার্গের ধারণা আজও যায়নি, অনেক সময়ে তা উন্নয়নের পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। ওড়িশার কিছু গ্রামে ‘গ্রাম বিকাশ’ নামে একটি অসাধারণ সংস্থা বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের নল এবং শৌচনালার সংযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, তবে তা এই শর্তে যে, ওই প্রকল্পে গ্রামের সকলকে যোগদান করতে হবে। কিন্তু একই জলের উৎস থেকে জল নিতে অনেকে আপত্তি তুললেন।

সম্ভবত জাতপাতের ধারণার এই শক্তির পিছনে সংরক্ষণ নীতির একটা ভূমিকা রয়েছে। নিজের পরিচয় নির্ধারণ করতে গিয়ে জাতকে ব্যবহারের অভ্যাস যাচ্ছে না, এটা অনেকটাই সংরক্ষণের জন্য। মহাত্মা গাঁধীর যে ধারণাটা ছিল, যে জাতপাত ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে, তেমনটা কিন্তু হতে দেখা যাচ্ছে না।

আমাদের ‘সোনালি অতীত’ আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে যাই, পঁচাত্তর বছর আগে কী দুর্দশা ছিল। দুর্ভিক্ষ, অনাহার, দরিদ্র ও দুর্বলের উপর নানা অন্যায়-অবিচার, বিপুল বৈষম্য, এই ছিল তখন ভারতের চেহারা।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্র: তা হলে সামনের পথ কী?

উ: কেবল আইন বা সরকারি বিধিনিষেধের চাপে কাজ না করে, আমাদের হৃদয় খুলে রাখতে হবে— দেশের মানুষ কী চায়, তার প্রতি। ভারতে গণতন্ত্র স্পন্দিত হচ্ছে গণ-আলোচনার পরিসরে, যার একটা বড় প্রকাশ আমরা দেখছি সমাজমাধ্যমে। সমাজমাধ্যমে প্রতিটি মানুষ কথা বলছেন এই ভেবে যে, “আমার মতটাই বা শোনা হবে না কেন?” কোনও এক ধরনের কথাবার্তা (‘ডিসকোর্স’) আধিপত্য পাবে, এটা তাঁরা মানতে রাজি নন। অবশ্যই সমাজমাধ্যমে অনেক ভ্রান্ত, মিথ্যা, আজগুবি কথাবার্তা রয়েছে, যেগুলোকে মান্যতা দেওয়া চলে না।

কিন্তু এ-ও বুঝতে হবে যে, মানুষের কাছে মান্যতা পাওয়ার যে পদ্ধতি এখন প্রচলিত, সেখানে এক ধরনের শ্রেণিব্যবস্থা কাজ করছে। এমনকি বিজ্ঞানের আলোচনাতেও আমরা ধরে নিই, কিছু লোক সব জানে, এবং তাদের কথা বাকিরা প্রায় দৈববাণীর মতো গ্রহণ করবে। ‘ইনি অমুক, অতএব ওঁর কথা সত্য’— এই হল মান্যতার মডেল। অতিমারির সময়ে আমরা দেখলাম বিজ্ঞানের দৌড়। কত ভিত্তিহীন সিদ্ধান্তকে ‘অভ্রান্ত সত্য’ বলে চালানো হল। এর একটা সমস্যা হল, বিজ্ঞানীর কোনও কথা ভুল প্রমাণিত হলে বিজ্ঞানের উপরেই মানুষের আস্থা চলে যায়। কোভিডের গতি-প্রকৃতি, তার নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রভৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অনেক বক্তব্য ভুল বলে বোঝা গেল প্রথম ঢেউয়ের পরে। অমনি দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে তাঁদের সতর্কতাকেও উড়িয়ে দিল মানুষ, এমনকি ভারতের সরকারও। ফলে যথাসময়ে পদক্ষেপ করা হল না। এটা এড়ানো যেত, যদি বিজ্ঞানীরা তাঁদের সিদ্ধান্তের পিছনের তথ্য-পরিসংখ্যান সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতেন, এবং তাঁর বক্তব্য ভুল হতে পারে, এই সম্ভাবনা বার বার সকলকে মনে করিয়ে দিতেন।

বিজ্ঞানীর বাক্যকে ‘দৈববাণী’ বলে দেখার আর একটা সমস্যা রয়েছে। যখন কোনও ধর্মগুরু বা রাজনৈতিক নেতা কোনও ভিত্তিহীন কথাকে ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’ বলে দাবি করেন, তখন তা বিশ্বাস করতে বহু মানুষের কোনও অসুবিধে হয় না। কারণ, ব্যক্তির উপর আস্থার ভিত্তিতে তার কথার সত্যতা মেনে নেওয়ার অভ্যাস আমাদের তৈরি হয়েই রয়েছে। বিজ্ঞানী সম্মাননীয়, ধর্মগুরুও তাই, তা হলে তাঁর কথাই বা মান্যতা পাবে না কেন?

প্রকৃত বিজ্ঞানী যে কোনও বিরুদ্ধ-মতের মানুষকে বলেন, “আমি এই পদ্ধতিতে জেনেছি, তুমি কোন পদ্ধতিতে এ বিষয়ে অন্য কথা জেনেছ বলো।” যা বলছেন তা কিসের ভিত্তিতে, কেন বলছেন, তা খোলাখুলি সকলকে বুঝিয়ে বলেন বিজ্ঞানী। এবং স্বীকার করেন যে, তাঁর ভুলও হতে পারে, অন্য মত ঠিক হতে পারে। কিন্তু ভারতে দেখা যাচ্ছে, যে কোনও বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁরা একটা উচ্চতা থেকে কথা বলেন, নিজের ভ্রান্তির সম্ভাবনা জনসমক্ষে স্বীকার করেন না। আজকের ভারতের গণ-আলোচনার পরিসরকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিসর করে তুলতে চাইলে বিজ্ঞানীকেও নিজের পরিচিতির মান্যতার চাইতে তথ্য ও যুক্তির মান্যতার উপর নির্ভর করে কথা বলতে হবে। উপর থেকে জ্ঞান আসবে নীচে, সংলাপের এমন উঁচু-থেকে-নিচু মডেল সমাজ গ্রহণ করলে প্রশ্ন করার অভ্যাস তৈরি হয় না কারও মধ্যে। বৈষম্যের সেখানেই শুরু। এই হল গণতন্ত্রের সঙ্কট, ভারতের সঙ্কট।

প্র: একই সঙ্কট কি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও হচ্ছে না?

উ: অবশ্যই হচ্ছে। তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা এমন অনেক দাবি করছেন, যেগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কোনও দাবি করা সম্ভবই নয়, কারণ তার জন্য উপযুক্ত তথ্য কারও হাতে নেই। মোট জাতীয় উৎপাদন, বা জিডিপি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটা হল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাতীয় উৎপাদনের হিসেব করতে গেলে যে সব তথ্যের প্রয়োজন হয় তার অন্যতম হল অসংগঠিত ক্ষেত্রের (‘ইনফর্মাল সেক্টর’) উৎপাদন। সেই তথ্য পাওয়ার জন্য পাঁচ বছর অন্তর সমীক্ষা করা হয়। কিন্তু শেষ যে সমীক্ষা করেছিল জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা, কেন্দ্রীয় সরকার তার রিপোর্টকে বাতিল করে দিয়েছে। তার পর আর কোনও সমীক্ষাও হয়নি। তা হলে কিসের ভিত্তিতে দাবি করা হচ্ছে যে, জিডিপি অমুক হারে বাড়বে? প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম যখন ২০১১-১২ থেকে ২০১৬-১৭, এই সময়কালের জিডিপি বৃদ্ধির হিসেব করতে গেলেন, তখন দেখলেন যে, সরকারের ঘোষিত বৃদ্ধির হারের (প্রায় ৭ শতাংশ) চাইতে তা অনেক কম (৪.৫ শতাংশ)। যেখানে ভ্রান্তির সম্ভাবনা (‘মার্জিন অব এরর’) এত বেশি, সেখানে কেনই বা বিশেষজ্ঞরা তর্ক করছেন, বৃদ্ধির হার ৬.৩ ‌শতাংশ হবে না কি ৬.৭ শতাংশ হবে? এই বচসা অর্থহীন। অসংগঠিত ক্ষেত্র আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে বলে জিডিপি আসলে কমছে— সে ঝুঁকিও কি আমরা উড়িয়ে দিতে পারি?

প্র: আবার, জিডিপি যখন বেড়েছে, তখন আর্থিক অসাম্যও বেড়েছে।

উ: কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাল কিছু করতে গিয়েও অসাম্য বেড়ে যেতে পারে। যেমন, যদি সংরক্ষণের জন্য নেতার স্থানে আরও বেশি মহিলা আসার সুযোগ পান, তা হলে মেয়েদের মধ্যে আর্থিক অসাম্য বাড়তে পারে। কারণ, সচ্ছল পরিবারের মেয়েরাই হয়তো বেশি আসবেন। কিন্তু তার থেকে সব মেয়েরই হয়তো খানিকটা লাভ হতে পারে, কারণ দেখা গিয়েছে, মহিলা নেতারা মেয়েদের প্রয়োজন মেটানোর দিকে বেশি মনোযোগী।

তার মানে একেবারেই এই নয় যে, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য বাড়লে তা আমাদের সব সময়েই মেনে নেওয়া উচিত। ১৯৪৭-১৯৮১ অবধি কমেছিল, তার পরের চল্লিশ বছর অসাম্য বেড়েছে। আমরা মুখে সাম্য নিয়ে যত কথা বলি, কাজে তার খুব কমই করি। ‘জিডিপি বাড়লেই সবার উন্নতি হবে,’ এই ধারণাটা চালু করার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু আমরা জানি এটা মিথ্যে কথা। ধনীর মুনাফাকে গরিবদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যে যে ধরনের কর ব্যবস্থা লাগে, তা আমাদের নেই।

এই অতিমারিতে অতিধনীদের ধন আরও বেড়েছে, আর সবাই পিছিয়ে গিয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা কী করছি? পেট্রল-ডিজ়েলে সেস বসাচ্ছি যা সবার পকেটে ঘা দেয়, কিন্তু সম্পত্তি কর বসানো হবে, এমন কথা তো কই শুনছি না? আগামী পঁচিশ বছর এই পরিবর্তন আনার দিকে যেতে হবে, যেখানে দেশের উন্নতি পরিণত হবে সবার উন্নতিতে।

সাক্ষাৎকার: স্বাতী ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abhijit Vinayak Banerjee Independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE