Advertisement
১১ মে ২০২৪
খরচ করার মতো টাকা চাই

পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বণ্টনে বাংলার ভাগে আরও কম পড়বে

চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সময়ই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি মাথাপিছু নিম্ন জিএসডিপি রাজ্যের অর্থবরাদ্দ সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কম ছিল।

সুরজিৎ দাস
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২১ ০৫:০০
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে গড়ে মাথাপিছু বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ এক লক্ষ এগারো হাজার টাকার চেয়ে সামান্য কম। অঙ্কটা কতখানি কম? হরিয়ানা, কর্নাটক, কেরল, তেলঙ্গানা, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে মাথাপিছু আয়ের অর্ধেকের চেয়ে কম। মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও এই রাজ্যগুলির চেয়ে ঢের কম। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯’এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ব্যয় বছরে গড়ে রাজ্যের এসডিডিপি-র ১৬.৬%। সর্বভারতীয় গড় ছিল ১৭%। এই একই সময়কালে গোটা দেশে যখন মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২১৫০০ টাকা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে অঙ্কটা ছিল ১৬৭০০ টাকা। এই রাজ্যে মাথাপিছু জিএসডিপি-র পরিমাণ কম, সত্যি— এই সময়কালে মাথাপিছু জিএসডিপি-র নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে পিছন দিক থেকে দশম স্থানে ছিল। কিন্তু, মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের নিরিখে ছিল পিছন দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ দুটো মাপকাঠিতেই দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দুটো রাজ্য। কিন্তু, এই সময়কালে এমন সাতটা রাজ্যও ছিল, সেখানে মাথাপিছু আয় পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম হলেও মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ এই রাজ্যের চেয়ে বেশি ছিল।

কেন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ এমন হতাশাজনক, সেই কারণের সন্ধান করতে হলে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে নিজস্ব কর আদায়ের পরিমাণ সর্বভারতীয় গড়ের সত্তর শতাংশও নয়। কর-বহির্ভূত রাজ্য আদায়ের পরিমাণ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় আরও কম। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ সমেত মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও শোচনীয়— সর্বভারতীয় গড়ের পঁচাত্তর শতাংশের কাছাকাছি। কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য বরাদ্দের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় গড় থেকে অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯’এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল ৭৭৫০ টাকা; সর্বভারতীয় গড় ছিল ৮৩১৭ টাকা। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাই স্বভাবতই প্রচুর প্রশ্ন ছিল।

গত নভেম্বরে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন তার রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। এই বছর তা সরকারি ভাবে গৃহীত হয়েছে। কমিশন সুপারিশ করেছে যে, কেন্দ্রীয় কর রাজস্বের ডিভিজ়িবল পুল-এর ৪১% রাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টন করা হোক। কোন রাজ্য কত টাকা পাবে, সেটা নির্ধারণের একটা ফর্মুলা রয়েছে। চতুর্দশ অর্থ কমিশন যে সূত্র মেনে টাকা বণ্টন করেছে, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সূত্র তার চেয়ে খানিকটা পৃথক। টাকা বণ্টনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যে মাপকাঠি, তার নাম পার ক্যাপিটা ইনকাম ডিসট্যান্স— কোনও রাজ্যের মাথাপিছু গড় আয়ের সঙ্গে দেশের ধনীতম রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান। যে রাজ্যের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান যত বেশি, এই খাতে তার অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ তত বেশি। চতুর্দশ কমিশনে এই মাপকাঠির ওয়েটেজ বা গুরুত্ব ছিল ৫০%; এই দফায় তা পাঁচ শতাংশ কমেছে। জনসংখ্যার গুরুত্বও ২৭.৫% থেকে কমে হয়েছে ১৫%। রাজ্যের আয়তনের গুরুত্ব ১৫ শতাংশে অপরিবর্তিত; রাজ্যে বনাঞ্চলের পরিমাণের গুরুত্ব সামান্য বেড়েছে; যোগ হয়েছে কম জন্মহারের গুরুত্ব, এবং কর আদায়ে রাজ্যের ভূমিকার গুরুত্ব।

চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সময়ই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি মাথাপিছু নিম্ন জিএসডিপি রাজ্যের অর্থবরাদ্দ সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কম ছিল। এই দফায় দু’টি মাপকাঠির গুরুত্ব পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাজ্যের বরাদ্দের উপর— পার ক্যাপিটা ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশন, ও রাজ্যের জনসংখ্যার গুরুত্ব হ্রাস। বরাদ্দ আরও কমবে।

কেন্দ্রীয় বরাদ্দ-সহ রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গ দেশে শেষ থেকে তৃতীয়— বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের পরেই। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বণ্টন-সূত্র এই রাজ্যগুলোর বরাদ্দের পরিমাণ আরও কমাবে। এখানে একটা কথা উঠে থাকে— যে রাজ্যগুলিতে মাথাপিছু আয় কম, সেখানে জনপরিষেবা প্রদানের গড় খরচও কম। অর্থাৎ, কেরলে কোনও জনপরিষেবা দিতে সরকারকে যে টাকা খরচ করতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে খরচ হয় তার চেয়ে কম। কথাটি যদি সত্যিও হয়, তবু এই ফারাক কতখানি? চতুর্দশ অর্থ কমিশন যে বণ্টন করেছিল, তাতে কেরলে মাথাপিছু কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। জনপরিষেবা প্রদানের খরচ নিশ্চয়ই এতটা বেশি হতে পারে না।

ধনী রাজ্যগুলির প্রকৃত আপত্তি, এবং সবচেয়ে জোরালো যুক্তি আসলে অন্যত্র। কেন্দ্রের আদায় করা কররাজস্বের যে অংশটা রাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টিত হয়, তার অপেক্ষাকৃত সমবণ্টনের প্রস্তাব উঠলেই ধনী রাজ্যগুলো আপত্তি জানিয়ে বলে যে, তাদের রাজ্য থেকেই কেন্দ্রের রাজকোষে বেশি কর জমা পড়ে, অথচ পাওয়ার বেলায় তাদের ভাগে কম পড়বে, কারণ গরিব রাজ্যগুলোকে বেশি টাকা দেওয়া হবে— এ ভারী অন্যায়। আপাত ভাবে কথাটা যদি গ্রহণযোগ্য ঠেকেও, কথাটাকে ভেঙে দেখা প্রয়োজন। প্রথমত, তুলনায় ধনী রাজ্যগুলিতে যে পণ্য ও পরিষেবা উৎপন্ন হয়, তা তো শুধু সেই রাজ্যগুলির গণ্ডির মধ্যেই বিক্রি হয় না— অন্যান্য রাজ্যের বাজারেও তার কেনাবেচা চলে। ফলে, সেই টাকায় শুধু ধনী রাজ্যের অধিকার, কথাটা মেনে নেওয়া মুশকিল। তার চেয়েও বড় কথা হল, এই ধরনের যুক্তি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। যদি ধনী রাজ্যগুলির জন্য বেশি টাকা বরাদ্দ করা হয়, তবে সেগুলি আরও ধনী হয়ে উঠবে; দরিদ্র রাজ্যগুলি দরিদ্রতর হবে। মাথাপিছু আয়ে আন্তঃরাজ্য ফারাক বাড়তেই থাকবে, এমনকি পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটি বা ক্রয়ক্ষমতার সাম্য ধরে আয়ের অঙ্ক হিসেব করলেও। ধনীতর রাজ্যগুলি বলতে পারে, তাদের অর্থনৈতিক ভাবে ভাল অবস্থায় থাকতে পারার জন্য শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। সে কথাটা যদি মেনেও নিতে হয়, তা হলেও কিছু নতুন ব্যবস্থা দরকার— যেমন, রাজ্যের মধ্যে আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি অসাম্য কমল কি না, বণ্টনের সূত্রে তার জন্য গুরুত্ব বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

ধনী রাজ্যগুলো আর একটা সুবিধা পায়, যেটা অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। সব রাজ্যের জন্যই যদি জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ তিন শতাংশে বাঁধা থাকে, তবে যে রাজ্যের জিএসডিপি যত বেশি, সেই রাজ্যে রাজকোষ ঘাটতির অঙ্কও তত বড় হতে পারবে। অর্থাৎ, রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের উপরে গরিব রাজ্যের তুলনায় আরও বেশি অঙ্কের টাকা খরচ করতে পারবে। এমনিতেও ধনী রাজ্যে কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্বের পরিমাণ গরিব রাজ্যগুলোর চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে, ধনী রাজ্যে মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯’এ কেরলে মাথাপিছু সরকারি ব্যয় ছিল ৩২,০০০ টাকার বেশি; পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১৬,৭০০ টাকার সামান্য কম।

পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট আইনের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে রাখতে রীতিমতো দায়বদ্ধ। রাজ্যে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমলে তাঁরা খরচ কমিয়েছেন, কিন্তু রাজকোষ ঘাটতি বাড়তে দেননি। এখন যে অভূতপূর্ব আর্থিক পরিস্থিতি চলছে, তাতে রাজকোষ ঘাটতি বিষয়ে এত সাবধানি না হওয়াই ভাল। এফআরবিএম আইনের কথা ভুলে সরকার ঋণ করে হলেও খরচ করুক। তাতে বেকারত্বের হার কমবে, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত। তা ছাড়াও, অন্যান্য নিম্ন আয়ের রাজ্যগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে পশ্চিমবঙ্গ একটা দাবি তুলতে পারে— জিএসডিপি-র অনুপাত হিসেবে নয়, রাজ্যগুলির রাজকোষ ঘাটতির উচ্চসীমা বেঁধে দেওয়া হোক নির্দিষ্ট টাকার অঙ্কে। এই দাবিটা আদায় করতে পারলে রাজ্যের হাতে খরচ করার সুযোগ বাড়বে, ফলে বাজারে চাহিদা তৈরি করার অবকাশও বাড়বে— ফলে, চাহিদার ঘাটতিজনিত সমস্যা থেকে রাজ্য নিস্তার পাবে। রাজ্যে-রাজ্যে আয়ের বৈষম্যও কমবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো দরিদ্র রাজ্যেও যাতে সরকার খরচ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা ছাড়া রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য উদ্ধার করা অসম্ভব।

সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE