Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সরকারে থেকেও বিজেপিই বিরোধী দল

জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের দুই শরিক পিডিপি ও বিজেপি-র মধ্যে েয চুক্তিই থাকুক, পিডিপি-র সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসলে দিল্লির বিজেপির কোনও উৎসাহ নেই। আর কে না জানে, শ্রীনগর রাজনীতির নিয়ন্ত্রক দিল্লিই।জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের দুই শরিক পিডিপি ও বিজেপি-র মধ্যে েয চুক্তিই থাকুক, পিডিপি-র সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসলে দিল্লির বিজেপির কোনও উৎসাহ নেই। আর কে না জানে, শ্রীনগর রাজনীতির নিয়ন্ত্রক দিল্লিই।

বদলার রাজনীতি। কাশ্মীরি নেতা সাবির আহমদ শাহ শ্রীনগরে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ান, তাই জম্মুতে তাঁর ছবি ও পাকিস্তানি পতাকা পোড়াতে ব্যস্ত শিব সেনা, ৩০ মে। ছবি: এপি।

বদলার রাজনীতি। কাশ্মীরি নেতা সাবির আহমদ শাহ শ্রীনগরে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ান, তাই জম্মুতে তাঁর ছবি ও পাকিস্তানি পতাকা পোড়াতে ব্যস্ত শিব সেনা, ৩০ মে। ছবি: এপি।

সুজাত বুখারি
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-র নেতৃত্বে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের শরিকি সরকার এই সবে ১০০ দিন পূর্ণ করল। শতদিবসকালের মধ্যে রাজ্যের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় তার খুব কমই মিলেছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই মুফতি মহম্মদ সইদ পাকিস্তান ও উগ্রবাদীদের উদ্দেশে দুর্ঘটনাহীন নির্বাচনপর্ব সমাপনের জন্য ধন্যবাদবার্তা দিয়েছিলেন: সেই প্রথম মুহূর্ত থেকে বিতর্কের শুরু। একশো দিন ধরে বিতর্ক কেবল ফুলেফেঁপে উঠেছে। গড়াতে গড়াতে বিতর্ক আর অশান্তির স্রোত এসে ঠেকেছে সম্প্রতি কালের মাসারাত আলমের মুক্তির দাবিতে, একই সঙ্গে একই মিছিলের মধ্যে পাকিস্তানি আর খলিস্তানি পতাকা উড়ানোর প্রশ্নে। সব মিলিয়ে আপাতত একটা জটিল জট, কৈফিয়ত আর অস্বীকারের মেঘকৃষ্ণ আবহ। পিডিপিকেই প্রধানত এর দামটা দিতে হচ্ছে। শরিক দল বিজেপির কাছ থেকে কারণে অকারণে ভর্ৎসনা সহ্য করতে হচ্ছে। সেই অর্থে প্রাদেশিক রাজনীতিতে এখন সরকারের অন্যতম শরিক বিজেপিই বৃহত্তম় বিরোধী দলের ভূমিকাটি পালন করছে। গণতন্ত্রের পরিহাস!

অথচ সরকার গঠনের আগে থেকেই দুই দলের মধ্যে অনেক আদানপ্রদান হয়েছে। অনেক কালি খরচ করে একটা উভয়ত-স্বীকৃত নীল নকশা তৈরি হয়েছে, যার নাম অ্যাজেন্ডা অব অ্যালায়েন্স। মুফতি অবশ্য তখনই দুই দলকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বলে বর্ণনা করেছিলেন, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এদের মধ্যে সন্ধির অর্থ অসম্ভবের আরাধনা। সরকারের ভাগিদার দুই দলের মধ্যে মিলের চেয়ে বেমিলটাই বেশি। তবু শেষ পর্যন্ত কতকগুলি দুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বোঝাপড়া ঘটানো গিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, সরকারে আসার প্রথম দিন থেকেই বিজেপি কথা রাখার চেষ্টাই করছে না। বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সমালোচকরাই সার কথাটি বলেছিলেন: অসম্ভবকে আরাধনা করেও পাওয়া যায় না, যা হওয়ার নয় তা হওয়ার নয়। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় দল তো একাধিক ক্ষেত্রে পিডিপিকে বেইজ্জত করে ছেড়েছেই। অন্য দিকে রাজ্য বিজেপি নেতারাও পিছিয়ে থাকেননি। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ নেওয়া যাক। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের (পিএমও) রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উধমপুরের সাংসদ জিতেন্দ্র সিংহ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বক্তৃতা দেবেন, এমন স্থির ছিল। উনি কিন্তু এসে মোটেই কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে বিশেষ কোনও বক্তব্য পেশ করলেন না। বরং রাজ্য রাজনীতির বিতর্কিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আরও বিতর্কিত কিছু মন্তব্য করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আপাতত অমরনাথ যাত্রা নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছে, প্রস্তাব এসেছে— এই যাত্রা নাকি সারা বছর খোলা রাখা হবে। স্বভাবতই এই নিয়ে মুসলিমপ্রধান কাশ্মীর ও হিন্দুপ্রধান জম্মুর মধ্যে বিস্তর টেনশন। জিতেন্দ্র সিংহ এসেই গলা খুলে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করতে শুরু করলেন। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস এই রাজ্যে একটি শাখা তৈরি করতে চায়। প্রথমে কথা ছিল সেটা শ্রীনগরে হবে। পরে হঠাৎই পরিকল্পনা পাল্টে জম্মুকে বাছা হল তার ঠাঁই হিসেবে। জিতেন্দ্র সিংহ সেই নিয়েও জম্মুর সপক্ষে সে দিন যুক্তি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে যা কিছু কাঁটা, যা কিছু স্বার্থসংঘাত, দেখা যাচ্ছে সেগুলিকে ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ করতেই বিজেপি রাজনীতিকদের বেশি উৎসাহ।

তবে একটা কথা বলতেই হবে। এরই মধ্যে অনেক দিন পর বিজেপির মধ্যে একটি সংবেদনশীল কণ্ঠ শোনা গেল। তিনি: রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী নির্মল সিংহ। শ্রীনগর ও জম্মুতে পাকিস্তানি ও খলিস্তানি পতাকা উড়ানোর বিষয়টিকে নিয়ে আপাতত যে ব্যাপক জলঘোলা চলেছে, দেখা গেল তাতে উশকানি দিতে তিনি একদম রাজি নন। তাঁর ধারণা, কিছু মাথাগরম ছেলেপিলের কাজ এ সব, ‘তত বড় কিছু নয়’। সপ্তাহ দুয়েক আগে জম্মুতে ভিন্দ্রানওয়ালের পোস্টার টাঙানোর ঘটনা নিয়ে যে খলিস্তানি অশান্তি শুরু হয়েছিল, এক জন তার জেরে মারাও গিয়েছিল— বিজেপি সম্ভবত বুঝে যায় যে বেশি আশকারা দিলে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। লক্ষণীয়, জম্মুর সেই অশান্তির মধ্যে শিখ হামলাকারীদের অনেকের হাতেই এক সঙ্গে ধরা ছিল পাকিস্তানি আর খলিস্তানি পতাকা! অভূতপূর্ব না হলেও খুবই অদ্ভুত ঘটনা বলতে হবে। ভিন্দ্রানওয়ালেকে এই ভাবে পুনরাবিষ্কার করে বিচ্ছিন্নতাবাদের স্পষ্ট স্লোগান: এমন কাণ্ড জম্মুতে দেখা গেল অনেক দিন পর। কিন্তু নির্মল সিংহ প্রেস কনফারেন্সে বিষয়টিকে অত গুরুত্ব দিতে রাজি হলেন না। হইচই বাধাতে চাইলেন না। তাঁর মতে এটা অত কিছু নতুন ব্যাপার নয়। এমন আগেও দেখা গিয়েছে। এ সব ঘটে, আবার মিলিয়েও যায়। তাই অত ‘গেল গেল’ রব না তুললেও চলবে। মজা হল, তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে। তথ্য বলছে, জম্মুতে এটা একেবারেই নতুন ব্যাপার। সম্ভবত দিল্লিতে নতুন বিজেপি রাজ এবং জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপির অংশগ্রহণে সরকার গঠনের সঙ্গে এই নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে। বিজেপি মন্ত্রীও সম্ভবত এ কথা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু তিনি যা জানেন, সেটা দিয়ে জল ঘোলা করতে তিনি রাজি নন।

তবে নির্মল সিংহ তো একক ব্যক্তি মাত্র! গত মাসেই শ্রীনগরে যখন পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো হল, সেই সময় দলগত ভাবে বিজেপির প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। মে মাসে কট্টরপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী সৈয়দ আলি গিলানি শ্রীনগরে প্রত্যাবর্তন করলেন, এবং আর এক কট্টরপন্থী মাসারাত আলমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান-পন্থী স্লোগান-সহ একটি মিছিলের আয়োজন করলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি তাদের মুণ্ডপাত তো শুরু করলই, সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীরও কঠোর সমালোচনা করতে লাগল, কেন তিনি এখনই গিলানিদের গ্রেফতার করছেন না। চাপের সামনে এই সরকার যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি বিশেষ দুর্বল নয়, সেটা প্রমাণ করতে শেষ পর্যন্ত সদ্যমুক্ত আলমকে আর এক বার গ্রেফতার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে এতে জড়িয়ে গেলেন। আলমের মুক্তির ঘটনায় গোটা দেশের যে অব্যক্ত ‘ক্রোধ’, নিজেকে তার ‘মুখপাত্র’ হিসেবে দাবি করে রাজ্য বিজেপি নেতাদের উপর তিনি এমন প্রবল চাপ দিলেন যে তাদের দাবি মেটাতে আলমকে আবার জেলে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হলেন মুখ্যমন্ত্রী মুফতি।

শ্রীনগরে যখন পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হচ্ছে, শ্রীনগরের স্থানীয় সংবাদ-মাধ্যম এবং সেখানকার নাগরিক সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা কিন্তু বার বার দিল্লিকে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। কাশ্মীরের রাজনীতিতে এই পাক-পতাকার ভূমিকা নতুন কিছু নয়, গত ছয় দশক ধরে বার বার অত্যুৎসাহীদের কারণে এমনটা ঘটেছে। কাশ্মীরের সমাজে পাকিস্তানি প্রভাব একটা বাস্তব। একে অস্বীকার করা চলে না। ১৯৮৯ সালের ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বহু-সমালোচিত ‘বাড়াবাড়ি’র পর থেকে এই প্রভাব তরতর করে বেড়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে, পাকিস্তান কাশ্মীরে যদিও অনেকটাই জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, কাশ্মীরি সমাজে কিন্তু ভারতের প্রতি ক্ষোভ বা রাগ এতটুকু কমেনি। ভারতের প্রতি এই ‘এলিয়েনেশন’-এর বোধ একটু একটু করে বাড়ছে বই কমছে না। এই হঠাৎ করে পাকিস্তানি পতাকা তুলে হইচই বাধানো, এ সবের মধ্যে সেই এলিয়েনেশন-এরই প্রত্যক্ষ ছাপ। এর মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই। কেবল স্থানীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে অতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, কিংবা কাশ্মীরে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সেটা দিল্লি থেকে ছকে দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বরং কাশ্মীরের পাকিস্তান-পন্থী শিবিরের হাতটাই আরও শক্ত হয়ে চলবে। এখন যেমন হচ্ছে।

শ্রীনগরের পতাকা-মিছিলের কিছু দিনের মধ্যেই ঘটল জম্মুর পতাকা-কাণ্ড। জম্মুর ঘটনায় নির্মল সিংহের যে সাবধানী মন্তব্যের কথা বলেছি আমরা। তার হেতুটা বুঝতে গেলে আমাদের আরও একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। জম্মুর পরিস্থিতি কিন্তু এখন প্রায় বারুদস্তূপের সামিল। বিচ্ছিন্নতাবাদের ভূত জম্মুর সমাজের এখানে ওখানে উঁকি মারছে। এবং প্রশাসনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার উত্তরে আরও তীব্র হচ্ছে। বাস্তবিক, সেখানকার ঘটনার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় আপাতত কিন্তু বিজেপি একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে, কেন্দ্রে রাজ্যে সর্বত্র যদি কথা আর কাজ দিয়ে মানুষকে সমানেই দেওয়ালের দিকে ঠেলতে থাকা হয়, পরিস্থিতি উত্তরোত্তর জটিল হয়ে উঠতে পারে। নতুন নতুন বিক্ষোভের উৎসমুখ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। জম্মু ও কাশ্মীরের অধিকার নিয়ে এখনও ভারত সরকার চিরাচরিত থো়ড়াই কেয়ার অবস্থানেই যদি স্থিত থাকে, রাজ্য রাজনীতিতে তার অবধারিত ছাপ পড়বেই।

জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারের একশো আট দিন হল। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের চালচলন থেকে সূর্যের আলোর মতো পরিষ্কার যে, রাজ্য স্তরে এখানে যতই অ্যাজেন্ডা অব অ্যালায়েন্স ইত্যাদি হয়ে থাকুক না কেন, পিডিপি-র সঙ্গে সত্যিকারের রাজনৈতিক ‘এনগেজমেন্ট’-এ কেন্দ্রীয় বিজেপির বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। উৎসাহ নেই স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়েও। গত সেপ্টেম্বরের বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ এখনও একই রকম সুদূর। কোনও রকম দ্বৈততায় বিশ্বাস না করে, কোনও যুগল দায়িত্বের পরিচয় না দিয়ে এই সরকার কত দূর যেতে পারে, দেখা যাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE