Advertisement
E-Paper

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস বসন্তের ফ্লুয়ের মতোই

সর্বভারতীয় ডিএলএড পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কারণে দুটো পরীক্ষা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাতিল করা হল এবং তা পুনরায় গ্রহণ করা হল। তা হলে এই প্রশ্ন ফাঁস করে লাভ কী হল? তবু যেন এই প্রশ্ন ফাঁস একটা উৎসব! লিখছেন শিবশঙ্কর দাসসর্বভারতীয় ডিএলএড পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কারণে দুটো পরীক্ষা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাতিল করা হল এবং তা পুনরায় গ্রহণ করা হল। তা হলে এই প্রশ্ন ফাঁস করে লাভ কী হল? তবু যেন এই প্রশ্ন ফাঁস একটা উৎসব!

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০২:১৩

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি কুখ্যাত ‘বাহাত্তর পঁচাত্তর’-এর গল্প। গণটোকাটুকি সে সময়কার অন্যতম ন্যক্কারজনক ঘটনা।

পরীক্ষার হলে বই দেখে লিখতে দিতে হবে, এই ছিল ছাত্রদের দাবি। অনেকাংশে এই আব্দার পূরণও হয়েছিল। সেটা হয়েছিল অনেকটা ভয় ধরানো চাপের কাছে। তখন অনেক স্যরই ছিলেন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’-র দলে। কিন্তু তাঁরা অন্তরে-অন্তরে দগ্ধ হতেন। মনে মনে আফসোস করতেন। মেনে নিতে পারতেন না এই অন্যায়। ছাত্রদের নীতিশিক্ষা দিতে পারেননি বলে নিজেরা অপরাধবোধে ভুগতেন। কিন্তু বুক উঁচিয়ে প্রতিবাদ করবেন, সেই সাহসও ছিল না।

যে সমস্ত শিক্ষক একটু সাহসী ছিলেন, তাঁরা প্রতিবাদ করতেন। কখনও সফল হতেন, কখনও আক্রান্ত হতেন। কিন্তু বোর্ডের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কথা শোনা যেত না। প্রশ্ন ফাঁস যা হত, বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সাজেশন আকারে। মাস্টারমশাইদের কাছের এবং দুর্বল ছাত্রদের দেওয়া হত যাতে তারা অন্তত পাশ করতে পারে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি কোর্সে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা বিশেষ ঘটত না। পরবর্তী কালে মাস্টারমশাইদের টিউশনের রমরমা বোর্ডের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসে উৎসাহিত করে তোলে। তখন এখনকার মত সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। ফলে আশির দশকে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কোচিং সেন্টার মোটা টাকায় খুব সূক্ষ্ম ভাবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি কোর্সের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিত।

কিছু অভিভাবকও এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। সাজেশন আকারে প্রশ্নগুলো বাইরে আসত। কোনও কোচিং সেন্টারের সাজেশনে বেশির ভাগ প্রশ্ন কমন এলেই লটারি লেগে যেত। প্রবেশিকা বা চাকরির পরীক্ষাতেও ছিল একই পদ্ধতি। এতে কেউ-কেউ বাড়তি সুযোগ পেত ঠিকই কিন্তু একটা রাখঢাক ছিল। প্রশাসন একটু তৎপর হলেই বেশ কিছু দিনের জন্য মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতে পারত। এখন সবটাই যেন খুল্লামখুল্লা। হুবহু প্রশ্নটাই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস না হলেই যেন ডিসক্রেডিট।

বিদ্যালয়ে ক্লাসের পরীক্ষায় পাশ-ফেল না থাকায় প্রশ্ন ফাঁস ব্যাপারটা এমনিতেই ফিকে আর ম্যাড়মেড়ে। কিন্তু বোর্ডের পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষা বা কোনও প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের সঙ্গে প্যাকেট খুলে বিস্কুট খাওয়ার মতোই সহজ। পরীক্ষা হচ্ছে অথচ প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে না, এ যেন নুন ছাড়া তরকারি। এনআইওএস-এর অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য সর্বভারতীয় ডিএলএড পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কারণে দুটো পরীক্ষা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাতিল করা হল এবং তা পুনরায় গ্রহণ করা হল। তা হলে এই প্রশ্ন ফাঁস করে লাভ কী হল? তবু যেন এই প্রশ্ন ফাঁস একটা উৎসব!

গত বছর উত্তরবঙ্গের একটি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্ন ফাঁসের পর এ বছর মাধ্যমিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাজার রকমের নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতি দিনই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এ যেন বসন্ত আগমনে ফ্লু। সকাল-সন্ধে প্রোটেকশন, তবুও কোথা দিয়ে সর্দি-কাশি, গালফোলা মাম্পস হচ্ছে, তার হদিস পেতে কালঘাম!

কেন প্রশ্ন ফাঁস হয়?

প্রবেশিকা বা চাকরির পরীক্ষায় না হয় একটা উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যটি হল র‌্যাঙ্ক নামক বস্তুটির মাথার দিকের অংশে অবস্থানের নিশ্চয়তা হাসিল করা। সেখানে অর্থ তুচ্ছ বস্তু। যা লাগে দিতে কুণ্ঠা নেই। স্থান পাকা হওয়া চাই। ফলে সেখানে ব্যাপারির অভাব নেই। কিন্তু মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে প্রশ্ন ফাঁস হয় কেন? র‌্যাঙ্ক হাসিলের জন্য? মনে হয় না। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে যারা র‌্যাঙ্ক করে তাদের অগ্রিম প্রশ্নের দরকার হয় না। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন প্রয়োজন হয় তাদের যারা প্রাত্যহিক পান্তা ভাত ছেড়ে ব্যঞ্জন সহযোগে একটু গরম ভাতের স্বাদ পেতে চায়।

তা ছাড়া এখন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে যে ধরনের প্রশ্ন হয় তাতে প্রশ্ন ফাঁস করে ব্যাপারিদের তেমন মুনাফা হয় বলেও মনে হয় না। কারণ প্রশ্ন ফাঁসের পুরাতন পদ্ধতি এখন অচল। মুঠোবন্দি ফোনের সাহায্যে পরীক্ষার মুখে ফাঁস করা প্রশ্ন বিনিময় ছাড়াই এক মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সেখানে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত এক পাতে আসীন। তা হলে প্রশ্ন ফাঁস কেন? আমার ধারণা, এক শ্রেণির অত্যুৎসাহী ব্যক্তি অজানাকে আবিষ্কারের আনন্দে মেতে এই কাণ্ড করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে জাহির করাই মূল উদ্দেশ্য।

যারা এই কাজটি করছে তারা কি জানে যে যাদের জন্য তারা এই কাজ করছে তারা উপকৃত হওয়ার চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি? পরীক্ষা হলে গিয়ে টুকলি সাপ্লাই দেওয়া লঘুমস্তিষ্ক ছেলে-ছোকরার কাছে আগাগোড়াই একটা চ্যালেঞ্জ। এখন কেউ-কেউ বোধ হয় ঘরে বসে সেই চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিচ্ছে প্রশাসনের কাছে— দেখো, আমি কেমন পারি?

তবে প্রবেশিকা বা চাকরি সংক্রান্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে আর একটি সমীকরণের কথাও শোনা যায়। যা কি না ব্যাপারিরা সূচারু রূপে ঘটিয়ে থাকে। পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর দুই-ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস করে দেওয়া হয়। দেখা যায়, উত্তরের বেশির ভাগই ভুল। সবাই যখন এই নিয়ে ব্যস্ত তখন ব্যাপারিরা আসল কাজটা সেরে নেয় পাশের দরজা দিয়ে। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি ভাবতে বসলেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।

ভবানীপুর মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক

Question Paper Leak Flue Spring
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy