ক্রান্তিকাল: ‘কৃষক ক্রান্তি পদযাত্রা’য় অংশ নেওয়া প্রতিবাদী চাষিরা বসে আছেন উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির সীমান্তে, ২ অক্টোবর, ২০১৮। পিটিআই
গাঁধীর জন্মদিনে খবরের কাগজ খুলতেই দেখলাম উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে রাজধানীতে বিদ্রোহী কৃষকরা প্রবেশের চেষ্টা করছেন। তার পরে প্রথম পাতা থেকে সম্পাদকীয় স্তম্ভে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখলাম, গাঁধীজিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বরচিত’ প্রবন্ধ। সত্যাগ্রহের পর স্বচ্ছতাগ্রহ। ভারত আবর্জনামুক্ত হচ্ছে। পাঁচ বছরে সে সাফল্যের খতিয়ান দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে প্রকাশিত। যখন টিভি খুললাম, দেখলাম, কৃষকদের ওপর পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট বৃষ্টি, লাঠি ইত্যাদি। গাঁধী জয়ন্তীতেই হাজার হাজার কৃষকের ওপর পুলিশের হিংসা। ২ অক্টোবর মধ্যরাতে পুলিশের ফরমান এল। ব্যারিকেড তুলে দেওয়া হচ্ছে। দিল্লির কিসানঘাট ছুঁয়ে এখনই যে যাঁর গ্রামে ফিরে যান। জঙ্গি কৃষকদের সরকার ঠান্ডা করে ফেরত পাঠিয়েছে। পর দিন মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকে তড়িঘড়ি রবি শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রয়াত মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের পুত্র নরেশ টিকায়েত। দিল্লির এক আমলা বললেন, ‘‘কী করে ত্রিশ হাজার কৃষককে ট্রাক্টর নিয়ে লুটিয়েনস-এর দিল্লিতে ঢুকতে দিই বলুন? আপনার মনে নেই, ওর বাবা কী করেছিল বোট ক্লাবে?’’
মনে আছে। ১৯৮৮ সালে সে ছিল প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর শেষ লগ্ন। টিকায়েত বোট ক্লাব এলাকা দখল করে ৫ লক্ষ কৃষককে ধর্নায় বসিয়ে দেন। প্রথম দিকে রাজীব গাঁধী ভাঙতে কেন, মচকাতেও চাননি। এক সপ্তাহ ধরে কৃষকরা দখল করে থাকেন ওই এলাকা। আমাদের অফিস থেকে বোট ক্লাব কাছেই। রাতে বাড়ি ফেরার সময় দেখতে যেতাম। চাষিরা ওখানেই আগুন জ্বেলে রান্না করছেন, প্রাতঃকৃত্য সারছেন। রাতে ট্রাক্টরে মশারি টাঙিয়ে ঘুম। পূতিগন্ধময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রাজীব সাত দিন পর দাবি মানতে বাধ্য হলেন। ৩৫ দফা দাবি মানা হল। চাষিদের ফসলের ন্যায্য মূল্য, বিনামূল্যে চাষের জমিতে বিদ্যুৎ ও জলের ব্যবস্থার আশ্বাস। এর পর বোট ক্লাবে ধর্না ও সভা করাই বন্ধ হয়ে গেল টিকায়েতের আন্দোলনের ভয়াবহতায়। আজ এত বছর পর যদি আবার পুত্র গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘিরে ফেলে? সে তো কেলেঙ্কারি!
আজ এত বছর পর দেশের চাষিদের দুর্গতির কাহিনি কিন্তু অবিকৃত। ২০১৪ সালের ভোটের সময় মোদীর আশ্বাস, এ দেশে আর চাষিদের আত্মহত্যা করতে হবে না। চাষিরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। দলীয় ইস্তাহারে ঘোষণা করা হয়েছিল, চাষিদের উৎপাদনের জন্য যা খরচ, তার সঙ্গে আরও ৫০ শতাংশ দেওয়া হবে। বাস্তবে তা হয়নি। ২০১৬ সালে সরকার কৃষকদের সমস্যা সমাধানে একটা কমিটি গঠন করল, যখন গোয়েন্দারাও বার বার রিপোর্ট দিচ্ছিল যে রাজ্যে রাজ্যে কিন্তু কৃষকের বিদ্রোহ বাড়ছে।
অতএব ‘অচ্ছে দিন’-এর কাহিনিতেও শ্যাওলা জমেছে। বঙ্কিমবাবু লিখেছিলেন, ‘‘...গোল শোনা যায় যে, আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। ...ইংরাজের শাসনকৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। ...দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে।’’ এবং, “...কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত... উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?” এই উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। সাহেবরা নেই, কিন্তু প্রভুরা আছেন। আছে ‘শাসনকৌশল’। আজকের বাবুরা খুশি, টিকায়েত বাহিনীকে দিল্লিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমরা সফল। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনকে কোনও সার্টিফিকেট দিচ্ছি না। কিন্তু ‘আ পার্টি উইথ ডিফারেন্স’, ‘অচ্ছে দিন’-এর পর দেখছি এ দেশে কৃষি উৎপাদনের হার আরও কমল। কৃষি সঙ্কট আজ আর শুধু কৃষি সঙ্কট নয়, এখন এটা গোটা দেশের সামাজিক সঙ্কট। সাংবাদিক পি সাইনাথের মতো আপনাকে কমিউনিস্ট হতে হবে না। কিন্তু মানতেই হবে, দেশের কৃষকদের সমস্যা নিয়ে তিনি যে কাজ করে চলেছেন, তা প্রশংসনীয়। সাইনাথের মতো এই পরিস্থিতিকে সভ্যতার সঙ্কট বলা যাবে কি না, সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু কৃষি সঙ্কট মানে এখন আর মাত্র জমির অধিকার হারানো বোঝায় না। বোঝায় না কেবল জীবন, জীবিকা ও উৎপাদনশীলতাকে হারানো। বিগত কুড়ি বছরে তিন লক্ষ চাষি আত্মহত্যা করেছেন। আমরা নীরব দর্শক হয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই আছি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো গত দু’বছর ধরে এই কৃষকদের আত্মহত্যা নিয়ে কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি। আবার আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নিয়েও জালিয়াতি হয়। নথিভুক্ত কৃষকের সংখ্যা কমে গিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে গণদেবতার অনিরুদ্ধ কামারদের সংখ্যা আজও বেড়েই চলেছে। এ দিকে স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে কী হল সাড়ে চার বছরে?
অতএব আমিও বলব, তোমাদের সঙ্গে ‘অচ্ছে দিন’-এর শ্রীবৃদ্ধির ঘণ্টায় হুলুধ্বনি দেব না। আমাকে বলতে হবে, আজও দেশে কৃষিজীবী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না।
মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের সময় থেকে আজ অনেক বদল এসেছে। মহেন্দ্র সিংহ মারা গেলেন অস্থি ক্যানসারে, ২০১১ সালে। তখন তাঁর বয়স ৭৬। তিনি ছিলেন দাপুটে কৃষক নেতা। কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বীরবাহাদুর সিংহ এক বার তাকে ঠান্ডা করতে মুজফ্ফরনগরের গ্রামে যান। টিকায়েত তাঁকে চেয়ার না দিয়ে জনসমক্ষে খাটিয়ায় বসতে দেন। থালা না দিয়ে খাওয়ার জন্য একটা লম্বা আখ দেন। ভাবটা এমন, চাষিদের গ্রামীণ জীবনটা বোঝার চেষ্টা করুন। বিশ্বনাথ প্রতাপও টিকায়েতবিরোধী ছিলেন। তিনি এক বার বলেছিলেন, দেখুন, এই টিকায়েতরাও কিন্তু গরিব চাষি নন। আপনি উত্তরপ্রদেশের জাঠ রাজনীতি অতটা জানেন না, ওঁরাও গরিব চাষিদের ওপর দাদাগিরি করেন। আজ কিন্তু চাষিদের পরিস্থিতি আরও জটিল। সে দিন ভূস্বামী আর গরিব চাষির মধ্যে সামাজিক বৈষম্য ছিল। আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে সকলের। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, ভারতে দারিদ্র কমেছে, কিন্তু বেড়েছে আর্থ-সামাজিক অসাম্য। এই আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের জন্য এক দিকে তৈরি হয়েছে অতি ধনী এক অভিজাততন্ত্র, যাকে বলা হয় ‘প্লুটোক্রাসি’। অন্য দিকে গরিব আরও গরিব হয়।
এ বার কৃষকরা যে হঠাৎ আন্দোলন করে দিল্লিতে ঢুকেছেন, তা নয়, মহারাষ্ট্র ও অন্য রাজ্যেও কৃষকরা গত এক বছর ধরে আন্দোলনরত। কৃষক নেতারা বলছেন, কৃষকদের মধ্যে একদম গরিব, তার চেয়ে একটু বড়লোক, এ হেন বহু স্তর থাকতে পারে। কিন্তু এই অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ মুছে কৃষকদের সমস্যা এক সম্মিলিত মঞ্চের কর্মসূচি হয়ে উঠছে। সরকারের জন্য অশনি সঙ্কেত।
এ বার যখন কৃষকরা আন্দোলন শুরু করলেন, যে দিন কৃষক বিদ্রোহ হল, তার পর দিনই মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে মোদী সরকার ঘোষণা করল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধি। আরও কিছু আশ্বাস। কিন্তু এটা তো ফি বছর রবি ও খরিফ শস্য উৎপাদনের পর এমনিতেই সরকার ঘোষণা করে, এও তো সেই ‘শাসনকৌশল’। আমাদের দেশের চাষিদের তাতে কী মঙ্গল হল?
সভ্যতার পিলসুজের বিদ্রোহ কি ঠেকাতে পারবে মোদী-সরকার?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy