সেকালে প্রজাদরদি রাজা বা জমিদাররা নাকি গরিবের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতেন। প্রজারা দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দিতেন। মনে হচ্ছে এই ২০১৮ সালে এসেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। কারণ মুখ্যমন্ত্রী কয়েক দিন আগে ঘোষণা করেছেন যে-সব দরিদ্র পরিবারের বার্ষিক আয় দেড় লক্ষ টাকার কম, তাঁদের সাবালিকা মেয়ের বিয়ের জন্য সরকার এককালীন ২৫,০০০ টাকা সাহায্য করবে। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে পরিবারের ওপর তৈরি হওয়া আর্থিক চাপ লাঘব করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। আপাতদৃষ্টিতে এ-উদ্দেশ্য সাধু বলেই মনে হয়েছে। বিরোধী দলনেতাদের তরফেও আপত্তি শোনা যায়নি।
কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, কেন শুধু মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য, ছেলের বিয়ের জন্যও কেন নয়! দরিদ্র পরিবারে কি ছেলের বিয়েতে কিছুই খরচ হয় না? না কি ধরেই নেওয়া হচ্ছে ছেলের বিয়ের খরচ পাত্রীর বাড়ি থেকেই আসবে, তাই টাকাটা সেখানেই দেওয়া দরকার! ১৯৬১ সালের পণপ্রথা বিরোধী আইন অনুসারে বিয়েতে পণ দেওয়া-নেওয়া দুই-ই অপরাধ। সে-ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে ‘মেয়ের বিয়ে’র খরচ বলতে বাকি থাকল কিছু উপহারসামগ্রী আর প্রীতিভোজ। সে-খরচ তো দুই পরিবারকেই করতে হয় আর সেটা সাধ্য মতো কাটছাঁট করারও উপায় আছে। কিন্তু ঘটনা এটাই যে মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তার পরিবার আজও যথাসাধ্য (এমনকী সাধ্যাতীতও) খরচ করেন আর সেই খরচের চাপ মেয়েটির ওপরও এতটাই চেপে বসে যে নেহাত নিরুপায় না হলে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে থাকতে বাধ্য হয়। তার ওপর সরকারি ভাবে ‘মেয়ের বিয়ের খরচ’ দেওয়ার মানে তো মেয়ের বিয়েতে ‘খরচ করা’টাকে স্বীকৃতি দেওয়াই হল। এই ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে যদি পাত্রপক্ষ ‘সরকারি টাকা’র ভাগ চাইতে হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই হাত ফিরিয়ে দেওয়া যাবে তো?
যতই বেটি বাঁচাই আর বেটি পড়াই, আজও আমরা কন্যার পাশে ‘দায়’ লিখি। তাকে সাধ্য মতো গড়ে তোলার পাশাপাশি তার বিয়ে ‘দেওয়া’ এখনও বাবা-মায়ের কাছে এক গুরুদায়িত্ব। গার্হস্থ্য হিংসা, পণের জন্য চাপ দেওয়া ও বধূহত্যার উদাহরণ যতই বেড়ে চলুক, ‘উপযুক্ত পাত্র’ পেলে প্রায় সব বাবা-মা-ই এখনও কন্যাকে পাত্রস্থ করাকেই সবচেয়ে প্রাধান্য দেন। তাই গ্রাম-শহর সর্বত্রই এখনও এত নাবালিকার বিয়ের খবর। সেই কিশোরীরা অনেকে এখন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে ভেঙে পালিয়েও আসছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকেই যদি মেয়েকে ‘সম্পদ’ নয়, ‘দায়’ ভাবার সমর্থন মেলে, আর তার বিকাশের বদলে বিবাহই বেশি জরুরি হয়ে ওঠে, তা হলে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারে আঠারো পেরোলেই কোনও মেয়ের বিয়ে ছাড়া আর কিছু করার উপায় থাকবে না! কারণ তার পরিবারের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা তো নেহাত কম নয়! মেয়েটি বিয়ে করতে রাজি না হয়ে পড়াশোনা বা অন্য কিছু করতে চাইলে যদি তার পরিবার একটা অনুদান থেকে বঞ্চিত হলে তার পরিবারের কাছে সেটা একটা আপশোসের কথা হয়ে উঠবে না তো?
এই প্রকল্পের নাম, রূপশ্রী। যদি বিয়েটা জীবনের একটা পরিণতি বলে ধরে নেওয়াও হয়, সেই বিন্দুতে পৌঁছতে একটি মেয়ের ভরসা যে তার রূপ (অর্থাৎ রূপ-ই সবচেয়ে বড় গুণ), শিক্ষাদীক্ষা বা মানবিক কোনও বৈশিষ্ট্য নয়, এই প্রকল্পের নাম থেকে তেমন একটা ধারণা হচ্ছে, যা অতীব আপত্তিজনক। যেন রূপ বা শ্রী না থাকলে সে অনুদানের উপযুক্ত নয়। কিংবা রূপ বা শ্রী-এর অভাব ঘোচাতেই এই অনুদান। বহু বছর ধরে গীতশ্রী, দেহশ্রী শুনে আসছি, শ্রী শব্দটিকে সম্মানজনক বা কল্যাণকামী বলেই জানি। কিন্তু এই প্রকল্পে শ্রী শব্দটা কার সম্মান বা কল্যাণ বোঝাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় হচ্ছে।
না, অনুদানের বিরোধিতা করতে চাই না। অনুদানটা প্রকৃত অভাবী মানুষের হাতে পৌঁছোচ্ছে কি না, সেটাও এখানে বিচার্য নয়। আপত্তিটা নৈতিক। এ-কথা সত্যি যে স্বপ্ন-সম্পদ-বিকাশ এই শব্দগুলো দারিদ্রসীমার কাছাকাছি গিয়ে অর্থহীন হয়ে পড়ে। সেখানে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। মেয়েটা খেয়ে-পরে নিরাপদে বেঁচে থাকুক, এটাই অনেক পরিবারে মেয়ের বিয়ের পিছনে স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যে-যে কারণে একটি দরিদ্র পরিবার মেয়েকে (মানে মেয়ের বিয়েকে) দায় বলে মনে করে, তার একটি হল পণের চাপ, অন্যটা মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতার অভাব। সরকার যদি এখানে কিছু কর্তব্য পালন করতে চায়, তবে সেই অবস্থানটাকে টিকিয়ে রাখাটা কর্তব্য নয়, বরং সেখান থেকে তাঁদের বার করে আনাই কর্তব্য। তাই অনুদান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটা বিয়ের পণ বা প্রীতিভোজের কাজে না লাগিয়ে তাদের স্বনির্ভর করার কাজে ব্যয় হওয়া উচিত। এই রকম অনেক প্রকল্পে সরকার অনুদান দেয়। সেই সংখ্যাই আরও বাড়ানো হোক। কোনও মেয়ে রূপসিই বা হোক, আর রূপহীনই হোক, তার বিয়ে হোক বাবা-মায়ের সামর্থ্য অনুযায়ী। আর তার স্বনির্ভর হবার চেষ্টায় সরকার পাশে থাকুক। তখন বিয়ের খরচ মেয়েই পরিবারের হাতে তুলে দেবে।
সুখের কথা, রাজনৈতিক নেতারা চুপচাপ থাকলেও আপত্তি জানাচ্ছে নাগরিক সমাজ। নারীবাদী সংগঠনগুলি প্রতিবাদ করছে ফেসবুকে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের বিপুল সাফল্যের পর তাঁরা বোধহয় গণতান্ত্রিক সরকারকে আদ্যিকালের রাজা-জমিদারের ভূমিকায় দেখতে চাইছেন না।
ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট-এর শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy