কলেজের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বরিষ্ঠ অধ্যাপক একরাশ বিরক্তি নিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকলেন। ছাত্রছাত্রীরা সঙ্গে মোবাইল আনছে আর গান চালিয়ে হাতে নিয়ে কলেজ চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিক্ষকদের দেখলেও সমীহ করছে না।
“ছেলেমেয়েগুলো বড্ড বাঁদর হয়ে গিয়েছে। বছর দশেক আগেও এমন ছিল না”— অধ্যাপকের বলার মধ্যে যে আক্ষেপ ফুটে উঠল তাতেই পরিষ্কার, এই সময়টা বড় বেশি প্রভাবিত করছে ছেলেমেয়েদের। খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে তারা। তাদের আচরণ, ভাবনা, চাওয়া-পাওয়া, মূল্যবোধ, অপরাধপ্রবণতা আমাদের চেনা জগৎ থেকে অনেকটা যে পৃথক তা বলার অবকাশ রাখে না। কিন্তু কারণ কী?
নব্বই দশক পরবর্তী সময়ের পারিপার্শ্বিকতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এক পরিবর্তিত সময়ের আভাস দেয়। সমাজ বা সময় সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু দু’দশকের বেশি ধরে চারপাশে ঘটে চলা পরিবর্তনে কিছু চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। এর উপাদানগুলি আমাদের প্রথাগত সমাজচেতনার বিবর্তনের ফল নয়। নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পরে এ দেশের আর্থ-সামাজিক স্তরে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভিত্তি ছিল উদারীকরণ। আন্তর্জাতিক স্তরে যে অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধের গণ্ডী ছিল, তা ক্রমশ বিলীন হয়ে আমরা হয়ে উঠেছি বিশ্বায়িত সমাজের বাসিন্দা।
এই উদার অর্থনীতির অন্যতম পরিণাম কেব্ল টিভি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি কেব্ল টিভির আগমনে আমরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপাচারে সমৃদ্ধ বিবিধ চ্যানেলগুলি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। জন্ম নেয় নতুন সামাজিকতাবোধ, সাংস্কৃতিক চেতনা, পালটে যেতে থাকে নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড। আমাদের প্রাত্যহিকতা, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক সম্পর্কের রসায়নে আসে এক সর্বাত্মক পরিবর্তন।
পাশাপাশি, ১৯৯১ সালের পরে সময় যত এগিয়েছে, অর্থনেতিক পরিকল্পনার সুফল তৃণমূল স্তরে এসে পৌঁছতে শুরু করেছে। একটা সচ্ছলতার ছবি ক্রমশ প্রতীয়মান হচ্ছে। আশির দশকের গ্রাম আর আজকের গ্রামের মধ্যে একটা চোখে পড়ার মতো পার্থক্য ঘটে গিয়েছে।
জনসংখ্যা অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে সন্তানের সংখ্যার চেয়ে সন্তানের মান বেশি প্রাধান্য পায়। ফলশ্রুতি, আজকের ছোট পরিবার যেখানে রাগ-অনুরাগ, হাসি-কান্নার ভাগিদার তিন জন বা খুব বেশি হলে চার জন মানুষ। বাবা-মা এখন যতটা না গুরুজন তার চেয়ে বেশি বন্ধুস্থানীয়। ফলে আদরে-আব্দারে, দাবি পেশে আজকের সন্তানেরা অনেক স্বাধীন। কিন্তু স্বাধীনতা বড় সংক্রামক ব্যাধি। যে মানুষটি বাড়িতে স্বাধীনতা ভোগ করে, কেনাকাটায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে কেবল নিজের ইচ্ছার মালিক, কলেজেও সে চায় নিজের নিয়মে চলতে। বাধা দিতে গেলেই বিপত্তি। ফলে কিছু অর্থে ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃঙ্খলতা আজকের সময়ের স্বাভাবিক প্রকাশ।
উদারনীতি-উত্তর কালে আমাদের জীবনে একটা সার্বিক পণ্যায়ন ঘটে গিয়েছে। পণ্যের স্বাভাবিক চরিত্র হল, তা সাবেক সমাজচেতনায় আঘাত হানে, নিজের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক স্তরবিন্যাসে তুল্যমূল্য হিসেবের মানদণ্ড রূপে শিক্ষা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার যে স্থান রয়েছে, তা ধীরে-ধীরে দখল করে নেয় পণ্য। এখানে সেটাই ঘটছে। ফলে সামাজিক স্তরবিন্যাসে বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত বিস্তারে সহজে সকলের হাতে পৌঁছে যাওয়া মোবাইলেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
মোবাইল এখন বিলাসের না প্রয়োজনের জিনিস— এই প্রশ্নের চেয়েও বেশি বিবেচ্য হল আজকের ছাত্র বা যুবসমাজের কাছে তার প্রাসঙ্গিকতা। মোবাইল এখন তাদের প্রতি মুহূর্তের বিনোদনের মাধ্যম, সামাজিক নেটওয়ার্কে তাদের উপস্থিতির বার্তাবাহক, নার্সিসিজ়মের সঙ্গী, সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের বর্ণাঢ্য উপস্থিতির প্রকাশ। মোবাইল এখন এক অধিকার। ক্লাসে মোবাইল ঘাঁটা অধিকার, পরীক্ষার হলে সঙ্গে মোবাইল রাখা অধিকার, কলেজের করিডরে মোবাইলে গান শোনা অধিকার, যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা অধিকার। সাধারণ সামাজিক রীতিনীতি, শালীনতাবোধ, সৌজন্যচেতনা সব কিছু উপেক্ষিত।
সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক শৈথিল্যও চোখে পড়ার মতো। যাকে আমরা নরম প্রশাসন বলি, সেই প্রশাসনিক দৃষ্টান্ত আমরা বিগত বছরগুলিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমরা যখন খুশি উচ্চৈস্বরে শব্দযন্ত্র ব্যবহার করতে পারি, এক দিনের পুজো তিন দিন ধরে পালন করতে পারি, প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রায় বা যে কোনও সময়ে প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে পারি, তার প্রতিবাদ করলে প্রয়োজনে প্রতিবেশীকে নিগ্রহ করতে পারি, থানায় অভিযোগ জানালে তাকে ধমকাতে-চমকাতে পারি।
সামাজিক বা প্রশাসনিক স্তরে এমন নানা রীতিবিরুদ্ধ কাজ করতে পারার একটা ধারণা আমাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে ছাত্রসমাজেও। একটা বেপরোয়া মনোভাবের বশবর্তী হয়ে পড়ছে তারা। তাদের আচরণে শ্রদ্ধাহীনতার প্রকাশ যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনই পরীক্ষা হলে অসৎ উপায় অবলম্বন করার মধ্যেও এক অধিকারবোধ জন্ম নিচ্ছে। আজকের দিশাহীন ছাত্র সংসদ যেমন এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করছে, তেমনই পরীক্ষা হলে গণটোকাটুকিতে সহায়তা করা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ছাত্র-হিতৈষী কাজ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ এক অশনি সংকেত।
বিগত প্রায় আড়াই দশক ধরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের এক দিকে রয়েছে পরিবর্তিত সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সর্বগ্রাসী পণ্যায়ন। অন্য দিকে এক শিথিল প্রশাসন। এ থেকে উত্তরনের পথ খোঁজা জরুরি। সমাজের সকল স্তরে যান্ত্রিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাই আজকের সময়ের অন্যতম সমাধানসূত্র হতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক স্তরে কার্যকরী নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়েই সেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পারিবারিক স্তরে সন্তানদের অসঙ্গত আব্দার, তাদের অবকাশ যাপন ও সামাজিকীকরণ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতনতা প্রয়োজন। ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন বা রাষ্ট্রজীবনে এই শৃঙ্খলার মাধ্যমেই সুশৃঙ্খল জনসমাজ গঠন সম্ভব।
মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy