Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জয়ী

পাঁচ বৎসরে কম বিতর্ক তৈরি হয় নাই, অপশাসন কিংবা কুশাসনের কম প্রতিবাদ হয় নাই। জাতীয়তাবাদের নামে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা হইয়াছে, দেশের উন্নয়ন স্থগিত হইয়া কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, সর্ব ক্ষেত্রেই গভীর সঙ্কট ঘনাইয়া বেকারত্ব সর্বোচ্চ হারে পৌঁছাইয়াছে— এই সমস্ত কথা অনেক শোনা গিয়াছে।

ছবি এএফপি।

ছবি এএফপি।

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৯ ২২:৩৮
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদী জয়ী, আবার। ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এক অর্থে ষোড়শ নির্বাচনের সমতুল্য। ফলাফল লইয়া কোনও দ্বিমত কিংবা বিতর্কের এক বিন্দু স্থান— সে দিনও ছিল না, আজও নাই। এমন ঘটনা বার বার দুই বার যিনি ও যাঁহারা ঘটাইতে পারেন, বলিতে হইবে, ভারতের নাড়িটি তাঁহারা চিনিয়াছেন অতি মোক্ষম ভাবে। তবে অন্য এক দিক দিয়া ভাবিতে গেলে, ২০১৯-এর জয় নিশ্চিত ভাবে ২০১৪-র জয়কে ছাপাইয়া যায়। পাঁচ বৎসর আগে ‘মোদী-ঢেউ’ উঠিয়াছিল, এবং উঠিয়াছিল প্রতিস্পর্ধী নরেন্দ্র মোদীর নামে, যিনি বিরোধী অবস্থানে থাকিয়া একটি নূতন দেশ গড়িবার স্বপ্ন দেখাইতে পারেন। আক্ষরিক অর্থে, তিনি সেই বার ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। বিপরীতে এই বারের জয় কিন্তু প্রশাসক নরেন্দ্র মোদীর, যিনি পাঁচ বৎসর ধরিয়া এই বিরাট দেশ শাসন করিবার পর জাতীয় নির্বাচনটিকে প্রবল সাফল্যের সহিত ভারতীয় জনতা পার্টির বদলে আর এক বার ‘নরেন্দ্র মোদীর ভোট’ করিয়া তুলিতে পারিলেন। অর্থাৎ এই জয় বিরোধী মোদীর নয়, ‘চ্যালেঞ্জার’ মোদীর নয়— এই জয় আসমুদ্রকাশ্মীর পরিচিত ও পরীক্ষিত মোদীর। দেশবাসী তাঁহার শাসনপদ্ধতি দেখিয়াছেন, ভাবনাচিন্তা বুঝিয়াছেন, এবং বিশাল জনমত দিয়া জানাইয়া দিয়াছেন যে তাঁহারা এই প্রশাসকের সহিতই আছেন, থাকিতে চাহেন। সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা সব দ্বিধাহীন ভাবে পিছনে হটিয়া গিয়াছে, মাথা উঁচাইয়া থাকিয়াছে কেবল অতি-জাতীয়তাবাদের মহা-আখ্যান, যুযুধান রাষ্ট্রের কল্পচিত্র। পাঁচ বৎসর শাসনের পর আবার এই জনমত তৈরি করিয়া ফিরিয়া আসা— সহজ ব্যাপার নহে।

পাঁচ বৎসরে কম বিতর্ক তৈরি হয় নাই, অপশাসন কিংবা কুশাসনের কম প্রতিবাদ হয় নাই। জাতীয়তাবাদের নামে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা হইয়াছে, দেশের উন্নয়ন স্থগিত হইয়া কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, সর্ব ক্ষেত্রেই গভীর সঙ্কট ঘনাইয়া বেকারত্ব সর্বোচ্চ হারে পৌঁছাইয়াছে— এই সমস্ত কথা অনেক শোনা গিয়াছে। বহু স্থানে কৃষক বিদ্রোহ ও যুব বিক্ষোভ দেখা গিয়াছে, দলিত ও জনজাতি আন্দোলনের আঁচ এক এক সময়ে বিস্ফোরণের আকার লইয়াছে। কিন্তু তবু, নির্বাচনের ফল বুঝাইয়া দিল, দেশের জনমানসে এই ঘটনাসমূহ প্রায় কোনও দাগ কাটিতে পারে নাই। বরং নাগরিক সমাজে গগনচুম্বী সাফল্য অর্জন করিয়াছে ‘বালাকোট’। বাস্তবিক, কেন যে বার বার নির্বাচন কমিশনের মান্য নীতি অমান্য করিয়া নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহরা বালাকোটের নামে ভোট চাহিতেছিলেন, তাহা স্পষ্ট। ইহাই, যাহাকে বলে, ওস্তাদের মার! আর প্রেক্ষিত হিসাবে, পাঁচ বৎসর ধরিয়া জাতীয়তাবাদের নামে অন্ধ পাকিস্তানবিরোধিতা এবং হিন্দু রাষ্ট্রের নামে আগ্রাসী সংখ্যালঘুবিরোধিতা অন্য সমস্ত বিষয়কে ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়াছে। ফুৎকার দিতে ভোটমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছেন দেশের বিরাট জনতা, যাঁহাদের শুধু সংখ্যাগুরু বা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুর অভিধায় সীমাবদ্ধ রাখা চলিবে না।

নরেন্দ্র মোদীর এ হেন পুনরাবির্ভাব ভারতীয় সমাজের এক বড় পরিবর্তনের পরিচায়ক। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবনা অপেক্ষা প্রকাশ্যত জাতীয়তাবাদী দৃঢ় রাষ্ট্রিকতা সেই সমাজের নিকট অধিক কাম্য। এমনকি যদি সেই রাষ্ট্রিকতা সামাজিক বিভাজনের হাত ধরিয়া আসে, তবুও। বিভাজনের বাস্তব আর এই নূতন ভারতকে বিচলিত করে না। অবশ্যই বার্তাটি উদ্বেগজনক। আগামী পাঁচ বৎসর লইয়া তাই উদ্বেগ থাকিয়া গেল। তন্মধ্যে একটি ক্ষীণ প্রত্যাশাও রহিল। সামনের পাঁচ বৎসর হয়তো নরেন্দ্র মোদীর শাসন কিছু অন্য কথা বলিবে, ভিন্ন ভাবে চলিবে। এই বৃহৎ বৈচিত্রময় দেশের বিবিধ নাগরিক সমাজের জন্য একটি সংযোগী ও উন্নয়নমুখী ভবিষ্যতের কথা ভাবিবার প্রয়াস করিবে। হয়তো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE