নির্যাতিতা মেয়েরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতেছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল নহে। বস্তুত, তেমন দৃষ্টান্তের সংখ্যা ক্রমে বাড়িতেছে, যাহা সমাজের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উনিশ জন মেয়ে যাহা করিয়াছেন, তাহাকে বিরল বলিলে কম বলা হয়। তাঁহারা খুব কম বয়সে অন্যায়ের শিকার হইয়াছেন, অনেকে শৈশবেই। অনেকেই যৌনপল্লিতে পাচার হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই কঠিন পরিস্থিতিকে নিয়তি বলিয়া ভাবিয়া লন নাই, নিশ্চেষ্ট বসিয়া থাকেন নাই, নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজিয়া লইয়াছেন সমাজ এবং প্রশাসনের সাহায্যে, স্থান পাইয়াছেন সরকারি আশ্রয়ে। কাহিনিগুলি এই অবধি পরিচিত। কিন্তু সেই মুক্তিতে তাঁহাদের সংগ্রামের কাহিনি শেষ হয় নাই, বরং তাহার নূতন পর্ব শুরু হইয়াছে। কেবল নূতন নয়, মহত্তর পর্ব। এই মেয়েরা অতঃপর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় নারী পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করিয়াছেন। নিছক প্রতিবাদ আন্দোলন নহে, আইন পড়িয়া, আইনের পথে লড়াই জারি রাখিতে চাহেন তাঁহারা। সেই জন্যই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই উনিশ জন আইন পড়িবার প্রস্তুতি শুরু করিয়াছেন।
এই পথটি বাছিয়া লওয়াই এই মেয়েদের লড়াইয়ের বিশেষত্ব। পথটি ব্যতিক্রমী। দীর্ঘকাল প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর ভর করিয়া ন্যায় চাহিবার একটি ধারা প্রচলিত। আন্দোলনকারীরা প্রশাসন ও আইনি ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ন্যায়ের পথ কাটিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন। তেমন আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কোনও অংশে কম নহে। কিন্তু এই উনিশ জন আইনজীবী হইয়া প্রশাসনিক কাঠামো তথা আইনি ব্যবস্থার ভিতরে থাকিয়া নিজেদের উদাহরণ ও অভিজ্ঞতা সম্বল করিয়া যে লড়াই চালাইতে পারিবেন, তাহা বাহির হইতে নির্যাতিতার সমব্যথী বা সহমর্মী হইয়া লড়াই লড়িবার চাহিতে অনেক বেশি জোরদার হইতে পারে। কারণ তাঁহাদের লড়াই কেবল অনুভূতি-সম্বল লড়াই নহে, অভিজ্ঞতা-সংবলিত লড়াই। তাহার ফলে সেই লড়াই অন্য মাত্রা অর্জন করিবে।
এবং আশা করা যায়, এই মেয়েদের লড়াই ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ হইবে। তবে ফলপ্রসূ করিয়া তুলিবার পথটি কঠিন। তাঁহাদের নিজেদের প্রতি দায়বদ্ধতাও বিরাট। আন্দোলন করিয়া ন্যায় না মিলিলে, তাহার বিফলতার দায় প্রশাসন ও আইনিব্যবস্থার উপর বর্তায়। কিন্তু নিজেই প্রশাসন ও আইনের অঙ্গ হিসাবে কাজ করিয়া ব্যর্থ হইলে, জবাবদিহি কেবল অন্যের কাছে নহে, নিজের কাছেও করিতে হয়। সেই ব্যর্থতার ভার বড় গুরু। তাই, এমন খবর জানিয়া প্রথমে যে উচ্ছ্বসিত আবেগ থাকে, বাস্তব পরিণতি অনেক সময় তাহার সহিত সামঞ্জস্য রাখিতে পারে না। বস্তুত, এই লড়াই স্ব-তেজ ও জেদ বজায় রাখিয়া লক্ষ্যে পৌঁছাইবার লড়াই। কারণ প্রত্যেককে নিজেদের লড়াই নিজেকে প্রতিনিয়ত লড়িতে হইবে। বাহিরের সমর্থন বলিতে সচরাচর কেবলমাত্র কিছু কালের উৎসাহ। সেই কারণেই সমাজের কর্তব্য ঔদাসীন্য ত্যাগ করিয়া এই মেয়েদের পাশে সর্বাত্মক ভাবে দাঁড়ানো। সাময়িক ভাবে নহে, নিরন্তর। ইহাতে কেবল এই মেয়েরাই সমর্থন পাইবেন না, সমাজেরও উত্তরণ ঘটিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy