ভারতে চিকিৎসাব্যবস্থা কয় প্রকার? সমাজের মাথারা খুব সহজে ভাগ করে দিয়েছেন: সরকারি ও বেসরকারি। বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে আবার রয়েছে দাতব্য ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। গত কয়েক মাসে বাণিজ্যিক বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা বার বার খবরে উঠে এসেছে। ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ কখনও উত্তপ্ত, কখনও অসহায় কিছু মুখ। আড়ালে থেকে যাচ্ছে কিছু অপ্রিয় সত্য।
চিকিৎসা সকলের অধিকার, তা মানা হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়েই। কিন্তু রূঢ় সত্য হল, আজ ভারতে সত্তর শতাংশ চিকিৎসা হয় বেসরকারি ক্ষেত্রে। কারণ, চিকিৎসার চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি সরকারি ব্যবস্থা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে যে পরিকাঠামো আছে, তা-ও যথেষ্ট নয়। জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতাল শয্যা এবং চিকিৎসক কত প্রয়োজন, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সূচক মানলে বলতে হয়, এ দেশে চাই অন্তত চব্বিশ লক্ষ শয্যা এবং বারো লক্ষ ডাক্তার। রয়েছে দশ লক্ষ শয্যা, এবং আট লক্ষ কর্মরত ডাক্তার। এঁদের বড় জোর কুড়ি শতাংশ সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে স্থায়ী চাকরি করছেন। আশি শতাংশই ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ নামক দিনমজুরি করছেন। কারণ, যথেষ্ট হাসপাতাল নেই।
বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার আটকে আছেন সরকারি নীতির দোটানায়। সরকার এখনও নিশ্চিত নয়, চিকিৎসা পণ্য না পরিষেবা? বেসরকারি হাসপাতাল বাণিজ্যিক হারে, লভ্যাংশের কথা ভেবে বিল বানালে সাধারণ মানুষ ও নেতারা অসন্তুষ্ট হন। অথচ একশো শয্যার একটা হাসপাতাল তৈরি করতে লাগে ষাট কোটি টাকা, মাসিক খরচ দুই-তিন কোটি টাকা। এর উপর ওষুধ, যন্ত্রপাতি। এই টাকা আসার একটা ন্যায্য উপায় চাই। হাসপাতালের মালিকরা কয়েক হাজার কোটি টাকা ধার করে চম্পট দিতে পারেন না। ছোট-বড়-মাঝারি, কোনও বেসরকারি হাসপাতালই মোটা অঙ্কের লাভ করতে পারে না। সরকারি নীতির অস্বচ্ছতায় আজ তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।
এই অনিশ্চয়তার ধাক্কা অনেকটাই পড়েছে ডাক্তারদের উপর। অনেক হাসপাতাল চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট বেতন না দিয়ে ‘ফি ফর সার্ভিস’ বা রোগী অনুসারে পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রথা চালু করছে। চিকিৎসকদেরও কেউ কেউ মনে করেন, রোগী-পিছু বা অপারেশন-পিছু পারিশ্রমিকের ব্যবস্থাটাই ভাল। তাতে নাকি পরিশ্রম ও দায়িত্বের বোঝা কিছুটা কম। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন চিকিৎসা-সম্পর্কিত আইনের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে একাধিক জায়গায় ছুটে বেড়ানো ডাক্তারদের পক্ষে বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। আইনের চোখে ‘ভিজিটিং’ ডাক্তারদের দায়বদ্ধতা ‘হোলটাইম’ ডাক্তারদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। মেডিক্যাল কাউন্সিল ও স্বাস্থ্য-কমিশনের প্রশ্নোত্তরের সামনে এই সত্যটা আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
দেড়শো বছর আগে পশ্চিমে ‘ফি ফর সার্ভিস’ প্রথার প্রচলন ছিল। কিন্তু উন্নত দেশগুলি দেখেছিল, এতে চিকিৎসার মান খারাপ হয়। অদরকারি ওষুধ, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার চিকিৎসার খরচ বাড়ায়। জীবিকা বজায় রাখা, বা রোজগার বাড়ানোর তাগিদে চিকিৎসকেরা নানা অনৈতিক কাজ করেন। তাই ১৯৪০-এর দশক থেকে ইউরোপের প্রায় সব দেশ এই প্রথাকে বর্জন করে চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন একটা পাঁচমিশালি ব্যবস্থা ছিল। ২০১০ সালে ‘ওবামাকেয়ার’ যখন স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা শুরু করল, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ডাক্তারদের একটা স্থায়ী পারিশ্রমিক পরিকাঠামোয় (স্টেবল কমপেনসেশন সিস্টেম) নিয়ে আসা। প্রায় তিন হাজার পাতার এই পরিকল্পনার অনেকটাই হল ডাক্তারদের রোগী-প্রতি টাকা নেওয়ার ব্যবস্থাটা বন্ধ করা।
আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলি এই বিষয়গুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি, স্বল্পমেয়াদি লাভ নিয়ে বেশি চিন্তা করেছে। এক দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক খরায় কবলিত হয়ে থাকার যে পরিস্থিতি, তার জন্য তারা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে, মেকি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা এতটাই মগ্ন, পায়ের তলার জমিটা যে আলগা হচ্ছে, তা বোধ হয়নি হাসপাতালের কর্তাদের। বেসরকারি হাসপাতালগুলি যদি নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ-ভিত্তিক একটি ছবি রাজ্য সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারত, তা হলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যেত।
আজ যে আট লক্ষ ডাক্তারের উপর ১২০ কোটি মানুষ নির্ভর করে রয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই এক অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিনমজুর। কিছু দিনের মধ্যে ‘মোদীকেয়ার’ (আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্যবিমা) শুরু হতে চলেছে। তাতে অনেক বেশি মানুষ চিকিৎসা পাবেন। সেটাই সবাই চাই। কিন্তু তার যোগ্য ব্যবস্থা কই? সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ প্রবল, তাই দায় বর্তাবে বেসরকারি হাসপাতালের উপর। তারা সরকার-নির্দিষ্ট দরে চিকিৎসা দিতে পারবে কি? না পারলে সেই ধাক্কার অনেকটাই ফের ডাক্তারদের বুক পেতে নিতে হবে।
ডাক্তার কখনও ক্ষিপ্ত জনতার হাতে প্রহৃত, কখনও আদালত বা মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রশ্নে জর্জরিত। অথচ সদর্থক চিকিৎসার জন্য যত শয্যা, যে পরিকাঠামো চাই, তা বেসরকারি ডাক্তারদের দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের নিধিরাম সর্দার করে রাখলে দেশ কি উন্নত, স্বচ্ছ হতে পারবে?
একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রশাসক-চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy