Advertisement
E-Paper

অর্থনীতি নয়, ব্যাপারটা রাজনীতির

আলেক্সিস সিপ্রাসরা আন্তর্জাতিক পুঁজির শর্ত মেনে চলতে নারাজ বলেই কি অ্যাঙ্গেলা মার্কেলরা এমন খড়্গহস্ত? গ্রিসের সংকট কি তবে পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের নতুন লড়াই?১৯৫০ সালে আমরা যদি বলতাম, জার্মানির মানুষ আজও ভাল করে নিজেদের ভুল বোঝেননি, তা হলে আপনারা মশাই এখনও গোটা দুনিয়ার ধার শোধ করতেন।’ এক জার্মান সাংবাদিককে মুখের ওপর কথাটি শুনিয়ে দিয়েছেন যিনি, হালফিল অর্থনীতির দুনিয়ায় তাঁর খ্যাতি প্রায় অতুলনীয়।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের (বাঁ দিকে) সঙ্গে গ্রিসের নতুন অর্থমন্ত্রী ইউক্লিড সাকালোতস।

প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের (বাঁ দিকে) সঙ্গে গ্রিসের নতুন অর্থমন্ত্রী ইউক্লিড সাকালোতস।

১৯৫০ সালে আমরা যদি বলতাম, জার্মানির মানুষ আজও ভাল করে নিজেদের ভুল বোঝেননি, তা হলে আপনারা মশাই এখনও গোটা দুনিয়ার ধার শোধ করতেন।’ এক জার্মান সাংবাদিককে মুখের ওপর কথাটি শুনিয়ে দিয়েছেন যিনি, হালফিল অর্থনীতির দুনিয়ায় তাঁর খ্যাতি প্রায় অতুলনীয়। তিনি ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি। গ্রিসের ঋণ শোধে অনীহা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন সেই সাংবাদিক।

কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির ঋণের সিংহভাগ মকুব করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত করেছিল মিত্রশক্তি, সে আলোচনা আপাতত থাক। তবে মনে রাখা ভাল, আজকের ইউরোপের সবচেয়ে বড় মহাজন জার্মানিকে সে দিন শুধু মানবিকতার স্বার্থে মিত্রশক্তির অন্য দেশগুলির সঙ্গে গ্রিসও ঋণ পরিশোধের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছিল। ইতিহাসের বিচিত্র গতি, আজ সেই গ্রিস মানবিকতারই দোহাই দিয়ে পরিত্রাণ প্রার্থনা করছে জার্মানির কাছে, এবং অ্যাঙ্গেলা মার্কেল সেই আবেদন শুনেও না শুনে রয়েছেন।

শুধুই মহাজনী প্রবৃত্তি? শুধুই বকেয়া আদায় করে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা? গ্রিসের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ৩,১৫,০০ কোটি ইউরো। অনেক টাকা? একটা তুলনাই যথেষ্ট। ২০১১ সাল অবধি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে মার্কিন সরকার খরচ করেছিল আড়াই লক্ষ কোটি ডলার। মানে, প্রায় দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার কোটি ইউরো। গ্রিসের ঋণের ঝাড়া সাড়ে সাত গুণ, তাও মূল্যস্ফীতির হিসেব না কষেই। সংখ্যা দুটো সরাসরি তুলনীয় নয় বটে, কিন্তু এর থেকে গ্রিসের বকেয়া ঋণের চেহারার একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। এখনই গলায় গামছা দিয়ে এই টাকাটা আদায় না করে নিলেও জার্মানির চলে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কেরও চলে। ইউনিয়নের অন্য যে দেশগুলি আর্থিক সমস্যায় কাবু, গ্রিসকে আরও সময় দিলেই তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে, তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল— প্রত্যেকটি দেশই গ্রিসকে আরও সময় দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল। তবুও, টাকা শুধবার সময়সীমা বাড়ানোর জন্য গ্রিসের ওপর আরও এক দফা আর্থিক কড়াকড়ির শর্ত আরোপ করল মহাজনরা। ৫ তারিখের গণভোটে সেই শর্তই মানতে অস্বীকার করলেন গ্রিসের মানুষ।

কঠোর আর্থিক নীতি মানে মূলত সরকারের খরচ কমানো। গ্রিসের সর্বজনীন পেনশন নিয়ে উত্তমর্ণদের ঘোর আপত্তি। ফলে, তাতে আরও এক দফা কাটছাঁটের ফরমান এসেছে। এ দিকে, উত্তমর্ণদের চাপিয়ে দেওয়া আর্থিক নীতি মেনে গ্রিস যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেটা কার্যত মানবতার সংকট। গত পাঁচ বছরে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমেছে ২৫ শতাংশ। দেশে প্রতি চার জন কর্মক্ষমের মধ্যে এক জন বেকার। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার তারও দ্বিগুণ— শতকরা পঞ্চাশ। যে পেনশন নিয়ে এত প্রশ্ন, গত পাঁচ বছরে তা-ও কমেছে ৪৩ শতাংশ। একদা মধ্যবিত্ত মানুষ আঁস্তাকুড়ে উচ্ছিষ্টের সন্ধান করছেন, স্কুলের ছেলেমেয়েরা টিফিনের পয়সা জোগাড় করতে ভিক্ষা করছে, কোলের শিশুকে গির্জার সিঁড়িতে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে মা-বাপ— ভাগ্যক্রমে যদি বেঁচে থাকতে পারে তো থাকুক। আরও আর্থিক কড়াকড়ি মানে যে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলা, মার্কেল বোঝেন না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির স্মৃতি যদি ১৯৫৪ সালের জাতকের না-ও থাকে, জাতিগত স্মৃতি অবিস্মরণীয়।

যে কথাটা আরও সহজে বোঝা যায়, সেটা হল, যে নীতির ফলে গ্রিসের জাতীয় আয় কমছে হু হু করে, সেই নীতির পথে হেঁটে ধার শোধ করার সামর্থ্য জন্মেও হবে না। বস্তুত, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার কথাটি বলেই ফেলেছে। এই মাসের গোড়ায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে আইএমএফ বলেছে, গ্রিসের ঋণের বোঝা এখন অপরিশোধ্য। ঋণ কমানো, এবং শোধ করার জন্য আরও সময় দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ঘোর আপত্তি ছিল এই রিপোর্ট প্রকাশে। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর অর্থনীতিতে নেই। আছে রাজনীতিতে।

মহাজনরা আসলে টাকা ফেরত চায় না। চাইলে, গ্রিসকে দম ফেলার ফুরসত দিত। আপৎকালীন ঋণ বন্ধ করে, তীব্র চাপ তৈরি করে তাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিত না। ইউরোপিয়ান কমিশন এবং জার্মানি বা নেদারল্যান্ডস-এর মতো দেশ সম্ভবত গ্রিসের ক্ষমতাসীন সিরিজা পার্টিকে শিক্ষা দিতে চায়। গ্রিসের মানুষকে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে সিরিজা পার্টি অথবা তার প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসকে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া মানুষের আর উপায়ান্তর নেই।

পিছনের রাজনীতির গল্পটা একেবারে আদি-অকৃত্রিম পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। সিরিজা পার্টি ঘোষিত ভাবেই বামপন্থী। আর্থিক কড়াকড়ির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা জানুয়ারি মাসে গ্রিসে ক্ষমতায় এসেছিল। তাতে অবশ্য মার্কেলদের সমস্যা থাকার কথা নয়। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশের রাজনীতিকদের কী ভাবে সরিয়ে আনতে হয়, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। হাতেগরম প্রমাণ ফ্রান্সের ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ। ২০১২ সালের নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, তিনি ইউরোপে আর্থিক কড়াকড়ির অবসান ঘটাবেন। তিনিই, এই দু’দিন আগে অবধি, গ্রিসকে পথে আনার যুদ্ধে মার্কেলের আদর্শগত সঙ্গী ছিলেন। কাজেই, সিরিজা পার্টিকেও পথে আনা যাবে, সেই বিশ্বাস ছিল। গত ছ’মাসে বিশ্বাসটি ভেঙেছে। সিপ্রাস, এবং তাঁর সদ্যপ্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিসকে বাগ মানাতে পারেননি তাঁরা। সিপ্রাসরা আর সরকারি ব্যয় ছাঁটতে রাজি হননি। এই বিদ্রোহ মার্কেলদের অসহ্য ঠেকেছে।

বিদ্রোহই বটে। ইউরোপ জুড়ে পুঁজিবাদের বিজয়রথ চালানোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কল্যাণ অর্থনীতিকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তার চেয়েও বড় কথা, লড়াইটা সিরিজা পার্টির একার নয়। আয়ার্ল্যান্ডে সিন ফেন, স্পেনে পোদেমস— ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে আগ্রাসী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে। সিরিজা পার্টি গ্রিসে ক্ষমতাসীন, ফলে তাদের পক্ষে সেই প্রতিরোধকে কার্যকর করা সহজ হয়েছে।

ঠিক সেই কারণেই সিরিজা পার্টির অস্তিত্বকে দুরমুশ করে দেওয়াও মর্কেলদের পক্ষে অপরিহার্য হয়েছে। অতএব এই আর্থিক চাপ। অবশ্য, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন শুল্‌জ আরও সহজ রাস্তা বাতলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিপ্রাসের সরকারকে ফেলে দিয়ে গ্রিসের শাসনক্ষমতা তুলে দেওয়া হোক টেকনোক্র্যাটদের হাতে। যাতে অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি মিশে যাওয়ার সুযোগ না পায়।

রাজনীতির প্রশ্নটাকে সরিয়ে রাখাও তো রাজনীতিই। আধিপত্যের রাজনীতি। পুঁজিবাদের পথটাকেই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, এবং সেই পথকে প্রশ্ন করলেই তাকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজনীতির দখলদারি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া। বলে দেওয়া, এই সব চক্করে পড়েই ‘অর্থনীতি’ গোল্লায় যাচ্ছে। শুল্‌জ বা মার্কেল যাকে ‘অর্থনীতি’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটা আসলে পুঁজিবাদের দর্শন। তা-ও সাবেকি, উৎপাদনকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ নয়, একেবারে লগ্নির পুঁজিবাদ। যাকে ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল বলে। দুনিয়া এখন এই পুঁজির যুক্তিতেই নিয়ন্ত্রিত হয়।

ইউরোপও হয়। খেয়াল করে দেখার, যখন ইউরো ছেড়ে গ্রিসের বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখনও শেয়ার বাজার অবিচলিত। কোথাও বড় কোনও ধাক্কা অবধি নেই। কেন? কারণ, গত পাঁচ বছরে মার্কেলরা ইউরোপের লগ্নি পুঁজিকে গ্রিসের বিপদ থেকে সরিয়ে নিতে পেরেছেন। দু’দফায় গ্রিসকে যে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে, সে টাকার সিংহভাগ আবার ঘুরে এসেছে ইউরোপের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিতেই। ফলে, আজ গ্রিস ডুবলেও তাতে লগ্নি পুঁজির ক্ষতি নেই। অতএব, গ্রিসকে আরও কোণঠাসা করার কাজটাও সহজতর হয়েছে। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজের লড়াইয়ের একেবারে চেনা ছক।

তবুও, এই চেনা ছকে নতুনত্বের ছোঁয়া আছে। মার্কেলদের পুঁজিবাদ এ বার যার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত, সিপ্রাসের সেই নীতিকে সমাজতন্ত্র বললে জোসেফ স্তালিন তাঁর কবরে নড়ে উঠবেন। সিপ্রাসের নীতিকে বড় জোর কল্যাণ অর্থনীতি বলা চলে। সাধারণ মানুষ যাতে বেঁচে থাকার সুযোগটুকু পায়, সেটুকু নিশ্চিত করতে যা করা প্রয়োজন, সিপ্রাস তার বেশি আর কিচ্ছু বলেননি। দেখা যাচ্ছে, মার্কেলদের পুঁজিবাদ এটুকু জায়গা ছাড়তেও নারাজ।

তবে মার্কেলই ইউরোপের একমাত্র প্রতিনিধি নন। তাঁর অবস্থানে অস্বস্তি হচ্ছে অনেকেরই। ওলাঁদ জানিয়েছেন, তিনি গ্রিসকে আরও সময় দেওয়ার পক্ষপাতী। বেলজিয়াম থেকে ইতালি, অনেক দেশই এক কথা বলছে। এখনই নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল, কিন্তু সম্ভবত ইউরোপে এক নতুন বিভাজিকা জেগে উঠছে। পুঁজিবাদকে কতখানি জায়গা ছাড়া যায়, সেই প্রশ্নে।

এবং, প্রশ্নটা গ্রিসের চেয়ে মাপে অনেক বড়। আপাতত গ্রিস সেই প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, এটুকুই যা।

Alexis Tsipras amitabha gupta economic crisis greece crisis political problem abp post editorial greece trouble scrip germany angela morkel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy