Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আর এক সুপারহিরোর গল্প

এক জনের মুখের কথায় যদি ছ’কোটি ভোট নড়ে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর গুণকীর্তন করে টুইট করবেন বটে। কিন্তু, এই ছ’কোটি জোগাড় হল কী ভাবে?

হিংসাত্মক: আদালতের রায়ে গুরমিত রাম রহিম দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ডেরা সচ্চা সৌদার ভক্তদের তাণ্ডব। পঞ্চকুলা, ২৫ অগস্ট। ছবি: এএফপি

হিংসাত্মক: আদালতের রায়ে গুরমিত রাম রহিম দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ডেরা সচ্চা সৌদার ভক্তদের তাণ্ডব। পঞ্চকুলা, ২৫ অগস্ট। ছবি: এএফপি

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না, গুরমিত রাম রহিম বাবাজির পক্ষে কী ভাবে এমন বিপুল সংখ্যক ভক্ত জোগাড় করা সম্ভব হল। চেহারা আর হাবভাবের কথা যদি বাদও দিই, বাবাজির বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। আছে খুনের অভিযোগও। এহেন বাবার মোট ছ’কোটি ভক্ত! অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিকও ফেল মেরে যাবেন।

এক জনের মুখের কথায় যদি ছ’কোটি ভোট নড়ে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর গুণকীর্তন করে টুইট করবেন বটে। কিন্তু, এই ছ’কোটি জোগাড় হল কী ভাবে? একটা উত্তর, পঞ্জাব-হরিয়ানায় জাতপাতের বাড়াবাড়ি। যুগের পর যুগ উচ্চবর্ণের হরেক দাপট সহ্য করতে বাধ্য হওয়া বিপুল সংখ্যক নিম্নবর্ণের মানুষ রাম রহিমের কাছে সমমানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। রাম রহিম ভক্ত নির্বাচনে জাতপাত মানেন না। প্রশ্নের দ্বিতীয় উত্তর, ডেরা সচ্চা সৌদার প্রকাশ্য কাজকর্মের অনেকখানিই চরিত্রে সমাজসেবামূলক। নিখরচায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে নেশামুক্তি কেন্দ্র, রক্তদান থেকে স্বচ্ছতা প্রকল্প, যৌনকর্মীদের উদ্ধার করে সমাজে পুনর্বাসনের কাজ, অনেক কিছুই চালায় ডেরা। রাষ্ট্রের কাছ থেকে যা বহু কষ্টে আদায় করতে হয় গরিব মানুষকে— এবং, অনেক সময় বহু চেষ্টাতেও যা অনাদায়ীই থেকে যায়— রাম রহিম তা বিলিয়ে দিয়েছেন।

তিনি আসলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন সেই সুপারহিরো হিসেবে, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিকার করার ক্ষমতা যাঁর আছে। নিজেকে সুপারহিরো বলবেন যিনি, তাঁকে এ ধরনের জনসেবামূলক কাজ করতেই হয়। যিনি এসে দাঁড়ালে নেশাগ্রস্তকে ফিরিয়ে আনা যায়, যৌনকর্মীরা ফের সামাজিক সম্মান পান, রাষ্ট্রের অপেক্ষায় না থেকে যিনি মানুষের সব প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে দিতে পারেন। গোটা দেশে এমন বিশ্বাস শুধু রাম রহিমকে নিয়েই তৈরি হয়েছে, বললে অন্যায় হবে। সুপারম্যান তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের যুক্তি মেনে। বিজ্ঞাপনের জোরে মানুষ যেমন একটি হেলথ ড্রিংককে দীর্ঘ দিন ধরে ‘পরিবারের মহান পুষ্টিদাতা’ হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে; যেমন বিশ্বাস করেছে যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি দাবি করছেন, শুধু তাঁর হাত ধরেই ‘অচ্ছে দিন’ আসতে পারে; তেমনই রাম রহিমকে মানুষ ‘মেসেঞ্জার অব গড’ বলে জেনেছে। সবার ওপরে বিজ্ঞাপন সত্য। তারও ওপর সত্য এক জন সুপারহিরোর জন্য মানুষের অপেক্ষা।

রাম রহিমের গল্পটাও যে সুপারহিরো নির্মাণেরই আখ্যান, এটুকু মেনে নিলে বাকিটা ডায়মন্ড হারবার-রানাঘাট-তিব্বত। যে কারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ একটা গোটা দাঙ্গাকে ভুলে যেতে পারে, ঠিক সেই কারণেই রাম রহিমের ভক্তরা একটা ধর্ষণ বা একটা খুনের অভিযোগকে ‘মিথ্যে’ বলে ধরে নিতে পারেন বেমালুম। মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় এই ঘটনাটির নাম ‘হেলো এফেক্ট’— অবতারদের ছবিতে তাঁদের মাথার পিছনে যে জ্যোতির্বলয় থাকে, তার নামে নাম। যাঁকে পছন্দ করি, আমাদের চোখে তাঁর দোষত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়। চোখে নয়, আসলে মনে। নিজেদের বিচারবুদ্ধির ওপর আমাদের প্রত্যেকেরই বেশ আস্থা আছে। এবং আস্থা আছে নিজেদের ন্যায্যতার বোধের ওপর। ফলে, আমরা যাঁকে পছন্দ করি, সেই লোকটি কোনও দিক থেকে মন্দ হতে পারেন, এই কথাটা বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে মুশকিলের। অতএব, যে তথ্যে আমাদের পছন্দের মানুষের গায়ে কালি পড়ে, সেই তথ্যটিকে হরেক যুক্তিতে অস্বীকার করাই মনের ধর্ম। যাঁরা বলছেন, রাম রহিমের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হওয়া তথ্য তাঁর ভক্তদের ঠিক ভাবে জানা নেই বলেই টোল পড়েনি তাঁদের ভক্তিতে, আচরণগত মনস্তত্বের ধোপে তাঁদের যুক্তি টিকবে না। জয়ললিতার জেলে যাওয়ার সময় যাঁরা নিজেদের গায়ে আগুন দিয়েছিলেন, তাঁরা কি নেত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা জানতেন না? জেনেও মানেননি।

মাসখানেক আগে এক বন্ধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মোদীভক্ত বন্ধুটি তখন জিএসটি-র গুঁতোয় নাজেহাল, মেজাজ তিরিক্ষি। একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, দেখো মোদীজি কী করলেন! সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, ‘এ রকম বোলো না, মোদীজি যখন করেছেন, তখন নিশ্চয়ই এতে ভালই হবে।’ যেমন, নোট বাতিলেও ভক্তরা দেশের ভাল দেখেছিলেন। চিনের সঙ্গে সীমান্ত-বিবাদে তো বটেই। নেহাত রাজনীতির জোরে এতখানি হয় না। হিন্দুত্বের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাতেও নয়। যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ, যাবতীয় অভিজ্ঞতার উল্টো দিকে হেঁটেও নেতার প্রতি এই অটল বিশ্বাস রাখতে গেলে যেটা দরকার হয়, তার নাম এনডাওমেন্ট এফেক্ট— নিজের হাতে যা আছে, তা হারিয়ে ফেলার ভয়। বিশ্বাস জিনিসটা মূল্যবান। কাজেই, অভিজ্ঞতার ধাক্কায় সেই বিশ্বাস ভাঙতে বসলে অভিজ্ঞতাটাকেই অস্বীকার করা— অথবা, তার পিছনে নিজের বিশ্বাসের সমানুবর্তী কারণ খুঁজে পাওয়া— এ নেহাতই মনের ধর্ম। যে মন এক বার কাউকে সুপারহিরো বলে মেনে নিলে সেই বিশ্বাসকে প্রাণপণ রক্ষা করে চলাই স্বাভাবিক। যে মন বিশ্বাস করে, রাম রহিম ক্যান্সার সারাতে পারেন, সে মনকে কি অত সহজে বিমুখ করা যায়?

কাজেই, রাম রহিমের সমর্থনে যাঁরা পঞ্চকুলার রাস্তায় জমা হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে টাকার বিনিময়ে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সবাই নয়। বাকিরা এসেছিলেন মনের তাগিদে। কিন্তু, তাতেও একটা প্রশ্ন থাকে। মানুষ তা হলে ঠিক এতখানিই হিংস্র যে তাঁরা এই মারাত্মক খুনখারাপিতেও পিছপা নন? পঞ্চাশ হাজার হোক বা দু’লক্ষ, এত জন মানুষের মধ্য একটা করে খুনি রয়েছে?

ভিড়ের মধ্যে থাকা মানুষকে এই প্রশ্ন করে লাভ নেই। একক মানুষ আর ভিড়ে থাকা মানুষ আসলে আলাদা। ভিড়ের নৈতিকতা তৈরি হয় ভিড়েই। ভিড়ের বৈশিষ্ট্য হল, সেখানে একক মানুষের আলাদা পরিচিতি নেই। ফলে, একা যে অন্যায় করা যায় না আইনের ভয়ে, ভিড়ে সেটা করে ফেলা যায় সহজেই— ধরা পড়ার সম্ভাবনা যেহেতু কার্যত শূন্য। কিন্তু, সেটাও পুরো গল্প নয়। নিজের বিশ্বাসের ওপর মানুষের যত আস্থা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার ওপর আস্থা তুলনায় ঢের কম। কোন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসবে, সেটা যখন অজানা, তখন ভিড় যে দিকে যায়, আমরাও সে দিকেই হাঁটি। বুড়ো আঙুলের নিয়ম— আমরা জানি, অনেক মানুষ এক সঙ্গে ভুল করতে পারে না। প্রসঙ্গত, যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার টিকে থাকে এই জানার ওপর ভর করেই।

এবং, খেয়াল করবেন, জনতা সচরাচর জড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিংসাত্মক হয় না। হিংসা আসে বহু ক্ষণ অপেক্ষার পর। অপেক্ষার এই সময়টা জরুরি। রাম রহিমের ক্ষেত্রেও যেমন। দু’দিন ধরে জড়ো হয়ে থাকা জনতা দোলাচলে ছিল, বিচারের ফল কী হয়। সেই দোলাচল চাপ ফেলে মানুষের মাথায়, তার ভাবার ক্ষমতার ওপর। একটানা চাপে থাকা মাথা শেষ পর্যন্ত ভাবনা বন্ধ করে দেয়। তখন না ভেবে কাজ করার সময়। অন্যরা যা করছে, বিনা ভাবনায় সেই কাজটাই করতে থাকে প্রত্যেকে।

এখানেই অল্প কয়েক জনের ভূমিকা, যারা ঠান্ডা মাথায় হিংসার ব্যবস্থা করে, অস্ত্রের জোগান দেয়, পথ দেখায়। তারা কিন্তু জনতার অংশ নয়। এই হিংসায় তাদের স্বার্থ থাকে বিলক্ষণ। গুলবার্গ সোসাইটি বা বেস্ট বেকারির ওপর চড়াও হওয়া জনতার সামনেও এরা ছিল, পাঁচকুলার রাস্তাতেও। হিংসা আরম্ভ হওয়ার আগে এই লোকগুলোকে সরিয়ে নিতে পারলেই বদলে যায় ভিড়ের চরিত্র। তখন বড় জোর হাহুতাশ থাকে, খুব বেশি হলে নিজের গায়ে আগুন ধরানো থাকে, কিন্তু দাঙ্গা নয়।

এই লোকগুলোকে সরাতে না পারাই প্রশাসনের আসল ব্যর্থতা, বা অপরাধ— ভক্তদের জমায়েত ঠেকাতে না পারা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE