Advertisement
E-Paper

পরিবারের কট্টরবাদীরাও এ বার মোদীকে নিশানা করছেন

উত্তরপ্রদেশের সেই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও তাঁর নিজের রাজ্যে মন্দির প্রসঙ্গে আদালতের রায়ের পর টিভি-সাক্ষাৎকারে খুব মেপে কথা বলতে হল। ‘মন্দির বানাবই’ না বলে বলতে হল, ‘মন্দির বানানোয় দেরি হয়ে যাচ্ছে বড্ড’, ‘বিচার ঠিক সময়ে হলে তবেই না তা সুবিচার’, ইত্যাদি সব নরমসরম কথা। 

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০০:২০
চ্যালেঞ্জ: অন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়ার সমাবেশ। অযোধ্যা, ২৩ অক্টোবর ২০১৮। পিটিআই

চ্যালেঞ্জ: অন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়ার সমাবেশ। অযোধ্যা, ২৩ অক্টোবর ২০১৮। পিটিআই

একা বামে রক্ষে নেই, দক্ষিণ দোসর!— এই কি ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী মোদীরা? সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার রামমন্দির মামলার শুনানি আগামী বছরে ঠেলে পিছিয়ে দেওয়ার কিছু আগে থেকেই রামমন্দির প্রশ্নে যে ভাবে কিছু চরম হিন্দু গোষ্ঠী উত্তাল হয়ে উঠেছে, তাতে কি বিজেপি নেতৃত্ব ঈষৎ চিন্তিত? যেটা হওয়ার কথা ছিল তাঁদের নিজেদেরই তুরুপের তাস, সেটা কি অবস্থাগতিকে হয়ে দাঁড়াচ্ছে গলার কাঁটা?

সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত শুনে বিরোধীরা কী বলতে পারে, মোদীরা জানেন। তাতে তাঁদের খুব কিছু এসে যায় না। রাহুল গাঁধী যতই বলুন না কেন, মোদী একাই মন্দিরের ঠিকা নেননি ইত্যাদি, এ সব কথায় বিজেপির ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি। কংগ্রেস যদি নরম হিন্দু্ত্ব করে, যদি মানস থেকে অযোধ্যা, সব তীর্থেরই খানিক খানিক অধিকার দাবি করে, তাতে বিজেপির চিন্তা নেই। হিন্দুত্বের ‘বি’ টিমকে ‘এ’ টিম কি ভয় পেতে পারে? কিন্তু অতি-রক্ষণশীল উগ্র হিন্দু গোষ্ঠীগুলি যদি এত বিরক্তি প্রকাশ করে, গৈরিক ধ্বজা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সরকারের সঙ্গেই সংঘর্ষে নামতে চায়, তাতে বিজেপির একটা ‘টাইট স্পট’ বা সঙ্কটে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অযোধ্যার দিকে যাত্রা শুরু করে প্রবীণ তোগাড়িয়া যখন বলেন, খুব হয়েছে, মোদীকে আর দরকার নেই, ‘হিন্দু ভারত’-এর জন্য মন্দির তাঁরা নিজেরাই বানিয়ে নেবেন— তার মধ্যে হিন্দুত্বের ঢেউয়ের পাশে বর্তমান সরকারের প্রতি যে একটা জোর ‘ছি ছি’, সেটা সামাল দিতে কোনও স্ট্র্যাটেজি অমিত শাহদের ভাবতে হতেই পারে।

আরএসএস-এর কথাটা অবশ্য অত সহজ নয়! প্রতিটি বিজয়া দশমীর দিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান একটি বার্তা দেন। এ বারও দিলেন, মোহন ভাগবত। বললেন, মন্দির তৈরি হলে তবে না দেশে ‘সদ্ভাব’ তৈরি হবে, ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে। সবাই তাকিয়ে আছে যে মন্দিরের জন্য, সেটা না হলে কি চলে? দরকারে, প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করতে হবে, ইত্যাদি! কিন্তু মোদী যে হেতু মোহন ভাগবতদের বিস্তর আস্থাভাজন, সেই জায়গাটা এই সব ভাষণালাপে বিপন্ন হয় না, মন্দির নিয়ে অধৈর্যের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা মেশে না।

শিবসেনা বিষয়ে কিন্তু সে কথা বলা যায় না। ওই একই সময়, দশেরার দিনই, মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরেও একটা বক্তৃতা দিলেন, যার মূল বক্তব্যটা শুনতে একই রকম। তবে তাঁর মন্দির-রবের পরতে পরতে মিশে রইল মোদী সরকারের সমূহ সমালোচনা, ধিক্কার। এই যেমন, মন্দির বানানো নিয়ে সমস্যা তো আজকের নয়, অনেক কালের। আসলে এনডিএ-র ডিএনএ-তেই সমস্যা, মন্দির তাই মোদী সরকারের অন্যতম ‘জুমলা’ ছাড়া কিছু নয়! ভোট কাছে এলেই মন্দির-মন্দির কলরব, তার পর মন্দিরের বদলে শৌচালয় নিয়ে মাতামাতি! অর্থাৎ মন্দির হল মোদীদের ভোটতরণির কান্ডারি। বিজেপি নীতি বিষয়ে উপভোগ্য একটি বাক্য ছিল এর মধ্যে: ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে লেকিন তারিখ নহীঁ বাতায়েঙ্গে’।

শিবসেনা অনেক দিন ধরেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার সরব। হয়তো বিজেপির কাছে নিজেদের জোর বাড়ানোর জন্যই। তাই অক্টোবরের উদ্ধব-বাচনে রামমন্দিরের হুঙ্কারের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে মহারাষ্ট্রের কৃষক রাজনীতি, কিংবা পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভ শুনে অবাক লাগল না। একই বক্তৃতায় সব কয়টি বিষয় মিশিয়ে তেতো পাঁচন তৈরি করলেন তিনি। শুধু স্বাদের কথা কেন, ধ্বনির কথাও বলা দরকার। বিজেপির বিরুদ্ধে বলতে উঠে উদ্ধব ঠাকরের কণ্ঠের ডেসিবেল-মাপ নাকি পৌঁছেছিল ৮৭.২-তে, যেখানে আদালত-স্বীকৃত শব্দোচ্চতা ৫৫ ডেসিবেল!

ঠাকরে টেনে এনেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর মন্তব্যও। কিছু দিন আগেই একটি সাক্ষাৎকারে গডকড়ী বলেছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে তাঁরা জিতে যাবেন, এমনটা ভাবেনইনি, তাই যা মুখে এসেছিল, সব রকম বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছিলেন! নিতিনের বয়ানে মন্তব্যটা যদিও ‘আমরা’ হিসেবেই এসেছিল, তবে প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কার প্রতি যে ঠেসটা দেওয়া হল, তা আর বলে দিতে হয় না। নিতিনের মোদীবিরোধিতা নিয়ে তখন চর্চাও হল অনেক মহলে। সে যা-ই হোক, নিতিনের মন্তব্য উল্লেখ করে উদ্ধব বললেন, না, মরাঠিরা কখনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয় না। অর্থাৎ, মোদীরা মিথ্যে বলতেই পারেন, কিন্তু উদ্ধবরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, (যার মধ্যে মন্দিরও পড়ে) তা রাখবার জন্য তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রবীণ তোগাড়িয়াও। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এই নেতাটি বেশ কিছু কাল ধরেই নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধতায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। গত সপ্তাহে তাঁকে দেখা গেল সমর্থকদের জড়ো করে মন্দির-নির্মাণের দাবিতে তাণ্ডব জুড়তে। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেল তোগাড়িয়ার নিজস্ব গোষ্ঠী অন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের। তোগাড়িয়ার ঘোষণায় জানা গেল, খুব দ্রুতই তিনি নাকি নতুন দল তৈরি করতে চলেছেন, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগেই। আর নতুন দল হলে মন্দির বানাতে কে তাঁদের আটকাবে— ‘অব কি বার হিন্দু সরকার’! নকল হিন্দু সরকারের বদলে আসল হিন্দু সরকার। অমিত শাহ পর দিনই গেলেন লখনউয়ে, সঙ্ঘ নেতাদের ডেকে বৈঠক করলেন। তাঁরা খুব ভাল রিপোর্ট দিলেন বলে তো মনে হয় না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রামমন্দির দাবির জোর যে বাড়ছে, তাও নিশ্চয় জানালেন। জানুয়ারির কুম্ভমেলার কল্যাণে সে চাপ যে আরও বাড়বে, তাও জানালেন। সরকার অর্ডিন্যান্স আনুক, এই কি তবে সমাধান?

কিন্তু সরকার কেন— সরকারের সুতো যার আঙুলে জড়ানো সেই আরএসএস-ও জানে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দুনিয়ায় সাধ আর সাধ্যের দূরত্ব লঙ্ঘন করা কত কঠিন। বাতাসে স্বপ্ন বপন করতে আইন-আদালত লাগে না। স্বপ্নকে মন্দিরের রূপ দিতে তা বিলক্ষণ লাগে। সুপ্রিম কোর্টের পাশ কাটিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা তো মুখের কথা নয়। রামমন্দির মামলা আজ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আদালতের চত্বরে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ, হঠাৎ কোনও অধ্যাদেশ দিয়ে তার সিদ্ধান্ত টেনে ফেলা মানে বিচারবিভাগ, আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের মাঝের রেখাগুলোকেই অগ্রাহ্য করা। ফলে বিজেপি সরকার খানিক সঙ্কটাপন্ন তো বটেই। মন্দির নির্মাণে অধ্যাদেশ দিয়ে মুশকিলে পড়া, কিংবা মন্দির নির্মাণের জন্য কিছুই না করে অতি-দক্ষিণবাদী চাপের মুখে অকর্মণ্য প্রতিপন্ন হওয়া— সম্ভাব্য দু’টি পথের কোনওটাই পছন্দসই নয়। তাই জন্যই নিশ্চয়ই, সব সময় যাঁর মুখ দিয়ে আগুন বর্ষণ হয়, উত্তরপ্রদেশের সেই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও তাঁর নিজের রাজ্যে মন্দির প্রসঙ্গে আদালতের রায়ের পর টিভি-সাক্ষাৎকারে খুব মেপে কথা বলতে হল। ‘মন্দির বানাবই’ না বলে বলতে হল, ‘মন্দির বানানোয় দেরি হয়ে যাচ্ছে বড্ড’, ‘বিচার ঠিক সময়ে হলে তবেই না তা সুবিচার’, ইত্যাদি সব নরমসরম কথা।

‘ভোটের আগে মেরুকরণ’-এর দিকে চোখ রেখে যাঁরা এগিয়ে চলেছিলেন, তাঁদের কাছে এ বড় সুখের সময় হতে পারে না। তাঁরা দেখছেন, যে ঘোড়ায় উঠে তাঁরা এত দূর অবধি টগবগিয়ে এসেছেন, সেটার লাগাম নিয়ে নিচ্ছে তাঁদের ‘দক্ষিণ দোসর’রা, চার পাশে জেগে উঠছে চরমবাদের ফণা, উত্তরপ্রদেশে এক রকম, মহারাষ্ট্রে আর এক রকম। দক্ষিণাবর্তে ঘোড়া ছুটিয়ে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কেন্দ্রে এসে ঢুকলে হয়তো এ রকম গর্তেই পড়ার কথা ছিল। নীরবতার অবকাশে হয়তো সেই হিসেবটাই কষছেন মোদীজি— রামমন্দির কি যোগের দলে, না বিয়োগের দলে? ভোটের আগে রামমন্দির কি তাঁর পাশে থাকবে, না উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড়াবে?

Rammandir Narendra Modi BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy