ইমরান খান ও তাঁহার দল তেহরিক-এ-ইনসাফ পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনে জিতিয়াছেন। কিন্তু ইমরান খান নিজেও জানেন, পাকিস্তানের মতো দেশে নির্বাচনে জেতাই ম্যাচ জেতা নহে। ৭১ বৎসরের ইতিহাসে পাকিস্তান যে সকল প্রধানমন্ত্রী পাইয়াছে, তাঁহাদের অনেকেই ভোটে জিতিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু হয় সেই ভোটের মধ্যে নাগরিক রায়ের প্রতিফলন ঘটে নাই, নতুবা নাগরিক পছন্দে জিতিয়া আসিবার পরে তাঁহাদের অন্য কোনও গূঢ় অ-গণতান্ত্রিক কারণে সরিতে হইয়াছে। একাধিক প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ সামরিক উত্থান হইতে শুরু করিয়া পরোক্ষ বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপের কারণে গ্লানিময় ও প্রহেলিকাময় প্রস্থানে বাধ্য হইয়াছেন। সুতরাং ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের রূপটি কেমন হইবে, এখনই বলা যায় না। কেবল একটি কথা আপাতত গ্রীষ্মসূর্যের ন্যায় প্রখর এবং জ্বলন্ত— পাকিস্তানের এত কালের নির্বাচনগুলির মধ্যে এ বারেরটিই সর্বাধিক অগণতান্ত্রিক। অভিযোগ, এ বারের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা রিগিং ছাড়াইয়া প্রি-রিগিং-এ ‘উন্নীত’ হইয়াছে। গত কয়েক দশকে কোনও নির্বাচনই সে দেশে সুষ্ঠু বা সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে ঘটে নাই, প্রতি বারই সামরিক বিভাগ নিয়ন্ত্রণ রাখিবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু এই বার যাহা ঘটিল, তাহা নিশ্চিত ভাবেই অভূতপূর্ব। ইমরান খান কেবল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সমর্থন-ধন্য প্রার্থী ছিলেন না, নানা অর্থেই তিনি সামরিক বাহিনীর সাক্ষাৎ মুখ হইয়া ভোটে নামিয়াছিলেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী এই নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভাবে ক্রিয়াশীল। ২০১৩ সালের নির্বাচনে যে সংখ্যক সেনাকে ভোটের সময় নামানো হইয়াছিল, এ বার সেই সংখ্যা তাহার দশ গুণ ছাড়াইয়াছিল। গণনা সম্পূর্ণ হইবার আগেই ৩০ শতাংশের ভিত্তিতে ফল ঘোষিত হইল। মিলি মুসলিম লিগের মতো কতকগুলি সেনা-সমর্থিত ছোট দলকে বাছা বাছা স্থানে ভোট-ময়দানে নামাইয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দল পিপিপি ও পিএমএল(এন)-এর ভোটভাণ্ডার হরণ হইল। এই প্রথম বার ইমরান খানের জয়কে ‘পাকিস্তানের জয়’ বলিয়া সেনা-হাইকম্যান্ড টুইট ছড়াইল। ব্যালটবাক্স বস্তুটিকে এ ভাবে নগণ্য করিয়া ‘গণতন্ত্র’ দেখাইবার প্রয়াস ভীতিজনক বলিলেও কম হয় না কি?
ভারতের নিকট এই নির্বাচনের অর্থ কী? জয়লাভের পরই ইমরান খানের ভারতবার্তা ভাসিয়া আসিল। সেই বার্তায় তাঁহার যে অবস্থান পরিস্ফুট, সেনাবাহিনীর অবস্থানের সঙ্গে তাহার মিলটি কাকতালীয় নহে। প্রতিবেশীদের সহিত সম্প্রীতি রাখিবার বার্তার সঙ্গেই সন্ত্রাস প্রশ্নে ভারতের দায় ও দায়িত্বের দিকে তির ঘুরাইয়া দিলেন এক কালের সুদক্ষ খেলোয়াড়। বালুচিস্তানে ভারতের ভূমিকার ইঙ্গিত প্রথম দিনের বক্তব্যেই জায়গা পাইল। সব মিলাইয়া, বলিউডের খলনায়ক না হইলেও ইমরান খান ভারতীয় গোয়েন্দা দফতরের পক্ষে বড় ধরনের দুঃসংবাদ, সন্দেহ নাই। এই প্রথম সামরিক ও অসামরিক নেতৃত্ব প্রায় একাসনে আসীন। ইহার অর্থ, নওয়াজ় শরিফের মতো নেতারা যেখানে নাগরিক সমাজের প্রতি কোনও না কোনও ভাবে নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতার পরিসর রাখিতেন, এ ক্ষেত্রে তাহা না থাকিবারই সম্ভাবনা। সেই হিসাব মাথায় রাখিয়াই দুর্দান্ত বোলারের ডেলিভারি: শরিফ ভারতের কথা মাথায় রাখিয়া রাজনীতি করিতেন, তিনি মাথায় রাখিবেন পাকিস্তানের কথা! এই বারের ভোটে সন্ত্রাসী পরিচয়ধন্য অনেককেই প্রার্থী হইতে দেখা গেল। পাক রাজনীতির মূলস্রোতে জঙ্গি ভাবাদর্শ জায়গা করিয়া লইতেছে, সংবাদটি ভারতের নিকট সুখকর নহে। ইমরান ‘তালিবান’ খান কী ভাবে তাঁহার জঙ্গি-সংযোগটি কাজে লাগাইবেন, তাহাও দেখিবার। আর একটি ক্ষেত্রেও ভারতের নিজেকে নিরাপদ ভাবিবার অবকাশ নাই। গণতন্ত্রের নামে দমনতন্ত্র চালাইবার প্রবণতাটি এক এক জায়গায় এক এক অবতার পরিগ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু প্রতিটি অবতারই বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy