Advertisement
E-Paper

বাংলার পটচিত্র ও যামিনী রায়

চারিদিকে যখন পাশ্চাত্য শিল্পের অনুপ্রেরণায় ছবি আঁকার চল শুরু হয়েছে, সেই সময়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ভূমিজ শিল্পকে। সেই শিল্পের পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি আজীবন অনড় থেকেছেন তার সমৃদ্ধির চেষ্টায়। যামিনী রায়কে নিয়ে লিখছেন নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায়চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের গৃহস্থালিতে পৌঁছে দেওয়া শিল্পী যামিনী রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৫
সৃষ্টিতে মগ্ন যামিনী রায়। ফাইল চিত্র

সৃষ্টিতে মগ্ন যামিনী রায়। ফাইল চিত্র

১৯২৫ সালের কাছাকাছি সময়। কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ পটচিত্রগুলোর উপরে চোখ পড়ল তরুণ শিল্পী যামিনী রায়ের। কালী চরিত্র এবং কাহিনি তুলির টানে, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। যেন ধাক্কা খেলেন। ‘ইম্প্রেশনিজম’ এবং ‘কিউবিজম’-উত্তর সময়ে শিল্পের এই সারল্য তাঁকে মুগ্ধ করল। খুঁজে পেয়েছিলেন, যা খুঁজছিলেন এত দিন ধরে।

চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের গৃহস্থালিতে পৌঁছে দেওয়া শিল্পী যামিনী রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের একটি সম্পন্ন পরিবারে। তাঁর পিতা রামতরণ রায়ও ছিলেন শিল্প অনুরাগী। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু শিল্পকর্মে মনোনিবেশ করবেন বলে। যামিনী রায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে বেলিয়াতোড় থেকে কলকাতায় যান। শিল্প শিক্ষার জন্য ভর্তি হন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। সেই সময় ওই প্রতিষ্ঠানের ভাইস-প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই ‘ক্লাসিকাল আর্ট ফর্ম’ নিয়ে পড়াশোনা করেন যামিনী। ১৯০৮ সালে ফাইন আর্টসে ডিপ্লোমা সম্পূর্ণ করেন।

এর পরে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘পোর্ট্রেট ড্রয়িং’-এর মাধ্যমে দিনযাপন করতে শুরু করেছিলেন। দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু যামিনী জানতেন, কোথাও কোনও শূন্যস্থান রয়ে যাচ্ছে। ঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থমকে রয়েছে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সেদিন কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই পথের সন্ধান পেয়ে গেলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলার লোকশিল্পকেই পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বঙ্গশিল্প জগতের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক খুলে গেল। দৈনন্দিন বঙ্গজীবন অতি সহজেই ধরা দিল শিল্পীর তুলিতে। আর এই সহজবোধ্য শিল্প সহজলভ্য হয়ে উঠল বঙ্গবাসীর কাছে। পৌঁছে গেল মধ্যবিত্তের অন্দরে। তৃতীয়ত, পুনরুজ্জীবিত হল বাংলার লোকশিল্প।

যামিনী রায় বলতেন, ‘আমি পটুয়া’। তাঁর ছবিও পটুয়া শৈলির। তাঁর কোনও নির্দিষ্ট পটুয়া ঘরানা নেই। ছবির চরিত্র শান্ত, কোমল। বিষয় কোথাও পুরান, কোথাও লোকসামাজিক জীবন। যামিনীর সে এক নীরব বিদ্রোহ। ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ও চিন্তনে আর কত কাল ভারতীয় চিত্রশিল্প আটকে থাকবে? যেখানে ভারত নিজস্ব চিন্তন ও দর্শনে সমৃদ্ধ। অবলীলায় ইউরোপীয় সাহচর্য ছেড়ে ফিরলেন শিকড়ের টানে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূলে। তবে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে দেখা সেজান, গগ্যাঁ, ভ্যান গখদের ছবির প্রভাব রয়ে গেল অন্তরে।

তাঁর নব অনুরাগ বাংলার লোকশিল্পে, সংস্কৃতিতে, লোকপুরাণে। লোকজ ছন্দ ও স্পন্দনে। ছবির ধারণা ও উদ্ভাবনায় বাংলার সাধারণ সমাজের ধর্ম, আচরণ, শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস উপজীব্য হল। তাঁর ছবির ফ্রেমে বাংলার উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, প্রাকৃতিক জগৎ ধরা পড়ল। তবে এ সব তিনি মূলত খুঁজে পেলেন বাংলার পটচিত্রে। পটুয়া পাড়ায়, কালীঘাট, বেলিয়াতোড়, বিষ্ণুপুরী টেরাকোটায়। বাঁকুড়ার পটচিত্রে ধর্ম, ধর্মচিহ্ন, বৈষ্ণব অনুরাগ, রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গল, মঙ্গলকাব্য আলেখ্য রচনা করে। থাকে প্রাণি ও উদ্ভিদের ‘মোটিফ’, জ্যামিতিক গড়ন। বর্ণে লাল-হলুদ-কালো-নীল। পটে ধরা দেয় নিজ ভাবনা, গোষ্ঠীর ভাবনা, শ্রুতি, মৌখিক পরম্পরা, হেঁয়ালি-প্রবাদ নির্ভর কল্পনার জাগরণ। এক কথায় ধরা দেয় মৌখিক সাহিত্যের চিত্ররূপ। অর্থাৎ, শৈলি নিজস্ব, পদ্ধতি ‘কমিউনিটি’র। এইখানটাই গ্রহণ করেছিলেন যামিনী রায়। আটপৌরে, জাঁকজমকহীন, প্রসাধনহীন সারল্য ভরা রেখা-রং থাকে তাঁর ছবিতে। তৈরি করেন সারি সারি রামায়ণ কথা, সাঁওতাল জীবন যাপন, কৃষ্ণলীলা। চরিত্রের আশ্চর্য চোখ দর্শককে স্থির করে দেয়।

১৯৩০ সালের শুরুর দিক থেকে যামিনী রায় পটুয়া শিল্প আহরণ করে শহুরে শিল্পজগতে নিজস্ব জায়গা প্রায় পাকা করে ফেললেন। ব্রিটিশ কলকাতার রাস্তায় এই প্রথম প্রদর্শিত হল কোনও ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। তাঁর আঁকা ছবির দাম এতটাই কম ছিল যে, মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের নাগাল পেতে অসুবিধা হল না। তবে এ-ও শোনা যায়, যদি শিল্পী কোনও ভাবে খবর পেতেন, তাঁর আঁকা ছবি কোনও ব্যক্তির বাড়ির দেওয়ালে অযত্নে আছে, তিনি তাঁর থেকে সেই ছবি কিনে নিয়ে চলে আসতেন। শিল্পের অমর্যাদা তাঁর সইত না।

ক্রমে পাশ্চাত্য দুনিয়াও তাঁর শিল্পের সন্ধান পেল। আগামী বছরগুলোয় যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল নিউ ইয়র্কে এবং লন্ডনে। বর্তমানে পৃথিবীর একাধিক আর্ট মিউজিয়ামে যামিনী রায়ের ছবি রাখা রয়েছে। পরের দিকে শিল্পী উপকরণেও পাশ্চাত্য বস্তু বাদ দিতে শুরু করেছিলেন। ক্যানভাসের বদলে ব্যবহার করতেন কাপড় দিয়ে তৈরি উপকরণ। রঙ তৈরি করতেন প্রাকৃতিক পদার্থ দিয়ে।

১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণে সম্মানিত হন এই শিল্পী। ১৯৫৫ সালে ললিত কলা অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’র সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

যামিনী রায়ের শিল্পে তাঁর জন্মস্থান বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার পটচিত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই শিকড় রক্ষার তাগিদ চোখে পড়ে না।

লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার

Jamini Roy Art Patachitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy